জনসংখ্যার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাড়ছে না ধানের উৎপাদনশীলতা


দৈনিক আলোড়ন
জনসংখ্যার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাড়ছে না ধানের উৎপাদনশীলতা

দেশে প্রতি বছর বাড়ছে জনসংখ্যা। অন্যদিকে ১ শতাংশ হারে কমছে কৃষিজমি। এ কারণে প্রধান খাদ্যশস্য ধানসহ অন্যান্য শস্যের জোগান নিশ্চিতে উৎপাদন বাড়ানোর ওপর জোর দেয়া হচ্ছে। ২০৫০ সাল নাগাদ দেশে চাহিদা পূরণের জন্য চালের প্রয়োজন হবে ৪ কোটি ৪৬ লাখ টন।

সে হিসাবে নতুন জাত উদ্ভাবন ও জিনগত বৈশিষ্ট্য পরিবর্তনের মাধ্যমে বছরে হেক্টরপ্রতি ৪৪ কেজি হারে চালের উৎপাদন বাড়াতে হবে। তবে জনসংখ্যা বাড়লেও সে হারে দেশে উদ্ভাবিত ধানের জাতের উৎপাদনশীলতা বাড়ছে না। বর্তমানে জাত উদ্ভাবন ও জিনগত কারণে বছরে প্রতি হেক্টর জমিতে ১০ কেজি হারে চাল উৎপাদন বাড়ছে। সম্প্রতি থিওরিটিক্যাল অ্যান্ড অ্যাপ্লায়েড জেনেটিক্স, স্প্রিংগারের প্রকাশিত বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) বিজ্ঞানীদের এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে।

‘৫০ ইয়ার্স অব রাইস ব্রিডিং ইন বাংলাদেশ: জেনেটিক ইল্ড ট্রেন্ডস’ শীর্ষক গবেষণায় ১৯৭০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ব্রি উদ্ভাবিত ধানের জাতের জিনগত প্রবণতা, ব্যবস্থাপনা ও আবহাওয়াগত কারণে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির হার পর্যালোচনা করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, জিনগত উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর পাশাপাশি কৌশলগত ও ব্যবস্থাপনাগত কারণে বর্তমানে চালের উৎপাদনশীলতা বাড়ছে বছরে হেক্টরপ্রতি ২০ কেজি করে।

দেশে আবাদকৃত ধানের প্রায় ৭০-৮০ শতাংশই বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) থেকে উদ্ভাবিত জাত। ১৯৭০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত বোরো মৌসুমের জন্য ৪১টি ও আমন মৌসুমের জন্য ৪৫টি ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এ সময়ে ব্রি উদ্ভাবিত বোরো মৌসুমের জাতগুলোর মোট উৎপাদনশীলতা বেড়েছে প্রায় ৪০ দশমিক ৯৬ শতাংশ। সে হিসেবে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির বার্ষিক হার দশমিক ৮২ শতাংশ। এর মধ্যে জিনগত কারণ অর্থাৎ জাত উদ্ভাবন ও বৈশিষ্ট্যগত উন্নয়নের কারণে উৎপাদনশীলতা বেড়েছে ১৩ দশমিক ৯১ শতাংশ। বার্ষিক হার দশমিক ২৮ শতাংশ। বাকি ২৭ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ বেড়েছে উৎপাদন ব্যবস্থাপনা ও কৌশলগত কারণে। যার বার্ষিক বৃদ্ধির হার দশমিক ৫৪ শতাংশ।

আমন মৌসুমের জাতগুলোর মধ্যে ২০১৯ সাল পর্যন্ত মোট উৎপাদনশীলতা বেড়েছে ৩৮ দশমিক ৩৯ শতাংশ। এর মধ্যে জিনগত প্রবণতার কারণে উৎপাদনশীলতা বেড়েছে ৮ দশমিক ৩৬ শতাংশ। বাকি ৩০ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ উৎপাদনশীলতা বেড়েছে উৎপাদন ব্যবস্থাপনা ও কৌশলগত কারণে।

‘রাইস ভিশন ফর বাংলাদেশ: ২০৫০ অ্যান্ড বিয়ন্ড’ শীর্ষক ব্রির অন্য এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতি বছর দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ২২ শতাংশ। সে হিসেবে ২০৫০ সাল নাগাদ দেশের জনসংখ্যা দাঁড়াবে ২১ কোটি ৫৪ লাখে। তখন দেশের মানুষের চাহিদা পূরণে ৪ কোটি ৪৬ লাখ টন চালের প্রয়োজন হবে। অন্যদিকে প্রতিনিয়ত কমছে কৃষিজমি। অন্যদিকে বেড়ে চলেছে বন্যা, লবণাক্ততা ও খরাসহ বিভিন্ন জলবায়ুগত ঝুঁকি। এ কারণে জিনগত কারণে বার্ষিক হেক্টরপ্রতি ৪৪ কেজি হারে উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে।

গবেষকরা জানিয়েছেন, গত ৫০ বছরে মোট উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির হার গড়ে ৩৯ দশমিক ৭ শতাংশ। বর্তমানে জাতীয় উৎপাদনশীলতার গড় হেক্টরপ্রতি ৩ দশমিক ১৭ টন। কিন্তু ২০৫০ সাল নাগাদ যে জনসংখ্যা হবে, সে চাহিদা পূরণ করতে হলে জাতীয় উৎপাদনশীলতার গড় হেক্টরপ্রতি ৪ দশমিক ৮৭ টনে উন্নীত করতে হবে। এর জন্য প্রতি বছর গড়ে হেক্টরপ্রতি ৪৪ কেজি চালের উৎপাদন বাড়াতে হবে।

গবেষণাটির মুখপাত্র ও বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা নিয়াজ মো. ফরহাত রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ধানের ক্ষেত্রে সাধারণত এশিয়ায় জিনগত উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি প্রাক্কলনের ওপর খুব সীমিত পরিসরে গবেষণা হয়েছে। বাংলাদেশে ভাত প্রধান খাদ্য হওয়া সত্ত্বেও এর আগে এ বিষয়ে কোনো গবেষণা করা হয়নি। আমাদের গবেষণার প্রাপ্ত ফলাফল অনুযায়ী, আমরা এটা বলতে পারি যে বাংলাদেশের খাদ্যনিরাপত্তা বজায় রাখার জন্য নতুন নতুন আধুনিক ব্রিডিং প্রযুক্তি যেমন প্রজনন চক্রের সময় কমানো, লাইন নির্বাচনের নির্ভুলতা বৃদ্ধি এবং প্রজনন মান বৃদ্ধির জন্য নির্বাচনের নির্ভুলতা উন্নতি, জেনোম এডিটিং ও স্পিড ব্রিডিংয়ের মাধ্যমে ব্রি-তে ধানের ব্রিডিংকে আধুনিকায়নের মাধ্যমে জিনগত উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির হার আরো বাড়াতে হবে। ব্রি ইতিমধ্যে ট্রান্সফর্মিং রাইস ব্রিডিং ২০১৬ সাল থেকে বাস্তবায়ন করছে।’

চলতি বছর প্রকাশিত বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বিএআরসি) ‘প্রজেকশন অব সাপ্লাই অ্যান্ড ডিমান্ড ফর সিলেক্টেড ফুড ক্রপস ইন বাংলাদেশ বাই ২০৩০ অ্যান্ড ২০৫০’ গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০২১ সালে দেশে চালের চাহিদা ছিল ৩ কোটি ৫২ লাখ টন। স্বাভাবিক পরিস্থিতি অনুযায়ী, চালের বার্ষিক জোগান ধরা হয় ৩ কোটি ৭৫ লাখ টন। ফসল কাটায় ফলনের পার্থক্য বিবেচনায় নিয়ে সমন্বিত পরিস্থিতিতে সেই জোগান নেমে আসে ৩ কোটি ৫৬ লাখ টনে। যদিও প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে সে বছর চালের জোগান আসে ৩ কোটি ৪৬ লাখ টন। অর্থাৎ স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ওই বছর ২৩ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত থাকার কথা থাকলেও প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে উল্টো ছয় লাখ টন ঘাটতি হয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ধানের জাত উদ্ভাবনের সঙ্গে ধানের জিনগত কারণে উৎপাদনশীলতা আরো কীভাবে বাড়ানো যায়, সেদিকে নজর দিতে হবে। এছাড়া জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবেলায় এর সহিষ্ণু জাত উদ্ভাবন করতে হবে। কারণ উৎপাদনশীলতা যদি জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মেলাতে না পারে, তাহলে ভবিষ্যতে দেশের মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতে ঝুঁকি তৈরি হবে।

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক্স অ্যান্ড প্লান্ট ব্রিডিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আব্দুর রহিম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমাদের দেশে যে জাতগুলো রয়েছে তার মধ্যে বৈচিত্র্য আনতে হবে। চীন আমাদের চেয়ে উৎপাদনশীলতার হারে অনেক বেশি এগিয়ে আছে। তাদের যে উন্নত জাতগুলো রয়েছে, সেগুলো যদি এনে আমাদের দেশের জাতগুলোর সঙ্গে ক্রস ব্রিডিং করে জাত উদ্ভাবন করা সম্ভব হয়, সেক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা বাড়ানো সম্ভব হবে। এছাড়া ভবিষ্যতের চাহিদা মেটাতে হলে প্রজনন সক্ষমতা বাড়াতে হবে। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ও জিনোম এডিটিংয়ের মাধ্যমে উন্নত করা সম্ভব। যেসব রোগ হচ্ছে তা যদি আমরা প্রতিরোধ করতে পারি, তাহলে উৎপাদনশীলতা আরো বাড়বে। প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বাড়ানোর দিকে মনোযোগী হতে হবে।’

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীর বণিক বার্তাকে বলেন, ‘শুরুর দিকে আসলে সেভাবে উৎপাদনশীলতা বাড়েনি। কিন্তু ২০০৯ বা ২০১০ সালের পর থেকে প্রতি বছর ৬ দশমিক ৬ লাখ টন হারে উৎপাদন বেড়েছে। গত দুই বছরে এটা আরো বেড়েছে। এরই মধ্যে আমরা রাইস ভিশন ২০৫০, ডাবলিং রাইস প্রডাক্টিভিটি ২০৩০, ২০৪০ ও ২০৫০ প্রণয়ন করেছি। এতে আমাদের নতুন জাত উদ্ভাবনের পাশাপাশি ব্যবস্থাপনা উন্নত হবে। বর্তমানে যে জাত উদ্ভাবন হচ্ছে সেগুলো উৎপাদনশীলতার দিক থেকে আগের সব রেকর্ড ভাঙছে। আগে উদ্ভাবনের পর জাতের সম্প্রসারণে কিছুটা ধীরগতি থাকলেও এখন সম্প্রসারণ বেশ দ্রুত হচ্ছে। আমাদের লক্ষ্য হলো চার-পাঁচ বছরের মধ্যে জাতগুলোকে পরিবর্তন করা। মূল টার্গেট ২৫ কোটি মানুষের চাহিদা পূরণ করা। যেভাবে আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে তাতে ভবিষ্যতে চালের চাহিদায় সমস্যা হবে না।’

কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব ওয়াহিদা আক্তার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ধানের উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর বিষয়ে ধারাবাহিকভাবে গবেষণা চলছে। দেশে জমির পরিমাণ অল্প। এর মধ্যে প্রতি বছরই আবাদি জমি ধারাবাহিকভাবে কমে যাচ্ছে। অন্যদিকে জনসংখ্যা বাড়ায় সে অনুযায়ী চাহিদা বাড়ছে। অল্প জমিতেই উৎপাদন বাড়াতে হবে আমাদের। এখন জিন এডিটিং ও জিনোম এডিটিংয়ের মাধ্যমে উৎপাদন বাড়ানোর দিকে জোর দেয়া হচ্ছে। বর্তমানে দেশে যে পরিমাণ চাল উৎপাদন হচ্ছে তা দিয়ে চলে যাচ্ছে। কিন্তু ভবিষ্যতের প্রস্তুতির জন্য যা যা করা দরকার, সেদিকেই আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি।’