রমজান মাস শুরু হতে আর মাত্র ২৮ দিন বাকি। ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে শবেবরাতের আগেই বেসামাল হয়ে পড়েছে নিত্যপণ্যের বাজার। চাল থেকে শুরু করে সব ধরনের মসলার দাম ইতোমধ্যে আকাশ ছুঁয়েছে।
রোজায় অতিব্যবহৃত ছয় পণ্য-চিনি, ছোলা, ডাল, ভোজ্যতেল, খেজুর ও পেঁয়াজের দাম বাড়ানো হচ্ছে আরও দুই মাস আগে থেকেই। অস্বাভাবিক দামের কারণে সাধারণ মানুষের পাতে মাংস উঠছে না। পাল্লা দিয়ে বাড়ানো হচ্ছে মাছের দামও। ডিম কিনতে গুনতে হচ্ছে বাড়তি টাকা। এমন পরিস্থিতিতে নাজেহাল হয়ে পড়েছেন ভোক্তা।
বৃহস্পতিবার সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) পণ্যমূল্যের তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে-গত বছর রোজার আগে একই সময়ের তুলনায় প্রতিকেজি ছোলা ২৩.৩৩ শতাংশ বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। প্রতিকেজি চিনি ৪৮.৩৯ শতাংশ, মসুর ডাল ১২.৭৭ শতাংশ, ভোজ্যতেল ১৩.২৭ শতাংশ, খেজুর ২০ শতাংশ বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।
পাশাপাশি গত বছর একই সময়ের তুলনায় প্রতিকেজি চাল ৫.৬৬ শতাংশ, আটা ৬৫.৭১ শতাংশ, অ্যাঙ্কর ডাল ৪৭.৬৯ শতাংশ, রসুন ৬১.৯০ শতাংশ, হলুদ ২১.২১ শতাংশ, আদা ৯০ শতাংশ, জিরা ৮২.৪৩ শতাংশ, প্রতিকেজি গরুর মাংস ১৭.২১ শতাংশ, খাসি ২৩.৫৩ শতাংশ, ব্রয়লার মুরগি ৪১.৯৪ শতাংশ বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া প্রতিকেজি গুঁড়োদুধের দাম বেড়েছে ৩৫ শতাংশ।
জানতে চাইলে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান যুগান্তরকে বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ডলার সংকট, বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে পণ্যের দাম এমনিতেই বাড়তি। এর মধ্যে রোজায় বাড়তি মুনাফা করার প্রবণতা যুক্ত হয়েছে। ইতোমধ্যে অসাধুদের কারসাজির কারণে বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। বাজার তদারকি সংস্থাগুলোর হালছাড়া ভাবে অসাধুরা আরও সুযোগ নিচ্ছে। এখনই কঠোর পদক্ষেপ না নেওয়া হলে রোজায় পণ্যের বাড়তি দর ক্রেতাকে ভোগাবে।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর কাওরান বাজার, শান্তিনগর কাঁচাবাজার, নয়াবাজারসহ একাধিক খুচরা বাজার ঘুরে ও বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিকেজি ছোলা বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ১০০ টাকা। যা জানুয়ারি মাসে বিক্রি হয়েছে ৯০ টাকা ও গত বছর ডিসেম্বর মাসে বিক্রি হয়েছে ৮৫ টাকা। দুই মাসে বেড়েছে ১৫ টাকা।
প্রতিকেজি মসুর ডাল (ছোট দানা) বিক্রি হচ্ছে ১৩৫-১৪০ টাকা। যা ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে বিক্রি হয়েছে ১৩০ টাকা। সেক্ষেত্রে কেজিপ্রতি দাম বেড়েছে ১০ টাকা। আর দুই মাস আগে ৭০০-৭৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি আজোয়া খেজুর এখন ৮০০-৮৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ইরানি মরিয়ম খেজুর বিক্রি হচ্ছে ৭০০-৭৫০ টাকা। দুই মাস আগে ছিল ৬৫০-৭০০ টাকা কেজি। সৌদির মরিয়ম খেজুরের দামও বেড়েছে। এই খেজুর কেজিতে ১০০ টাকা বেড়ে এখন ৯০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর প্রতিকেজি সাধারণ মানের খেজুর বিক্রি হচ্ছে ৪৫০ টাকা। দুই মাস আগে ছিল ৩০০-৩৫০ টাকা।
পাশাপাশি প্রতিকেজি গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ৭৩০-৭৫০ টাকা। যা দুই মাস আগে ৭০০ টাকা ছিল। প্রতিকেজি খাসির মাংস বিক্রি হচ্ছে ১১০০ টাকা, আগে ৯৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। প্রতিকেজি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ২৩০ টাকা, যা দুই মাস আগে ১৫০ টাকা ছিল। প্রতিকেজি আমদানি করা রসুন বিক্রি হচ্ছে ১৯০ টাকা। যা দুই মাস আগে ১২০ টাকা ছিল। প্রতিকেজি দেশি আদা বিক্রি হয়েছে ২০০ টাকা, আগে ১৫০ টাকা ছিল।
কাওরান বাজারে নিত্যপণ্য কিনতে আসা মো. সহিদুল ইসলাম বলেন, বাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম হঠাৎ করেই বেড়ে গেছে। দুই মাসের ব্যবধানে বিক্রেতারা এক প্রকার নীরবে দাম বাড়িয়েছে। পরিস্থিতি এমন শবেবরাতের আগেই বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। মনে হচ্ছে রমজানে এই পণ্যমূল্য আরও বাড়বে।
গত কয়েক বছর ধরেই এমন চিত্র দেখা যাচ্ছে। কিন্তু বাজার তদারকি সংস্থাগুলো এক প্রকার নির্বিকার। তারা রোজা এলেই লোক দেখানো বাজার তদারকিতে উঠেপড়ে নামে। এতে ভোক্তার কোনো ধরনের উপকার হয় না। এজন্য রোজা ঘিরে দুশ্চিন্তায় আছি।
একই বাজারের খুচরা ব্যবসায়ী রাকিবুল বলেন, পাইকারি বাজারে অবিশ্বাস্যভাবে পণ্যের দাম বাড়ানোর কারণে খুচরা বাজারে প্রভাব পড়েছে। পাইকারি বাজারে সব ধরনের পণ্যের সরবরাহ থাকলেও দাম বাড়তি। এতে বেশি দামে এনে বেশি দামে বিক্রি করছি।
জানতে চাইলে মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো. বশির উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, অনেক পণ্যের ঋণপত্র খুলতে জটিলতায় পড়তে হচ্ছে। ব্যাংকগুলো এলসি খুলতে যাচ্ছে না। তাই সময়মতো পণ্য না আনতে পারায় কিছুটা দাম বেড়েছে। পাশাপাশি ডলারের মূল্য অনেক। সব মিলিয়ে রমজানে খেজুর ও ছোলার মতো পণ্যের দাম আরও কিছুটা বাড়তি থাকতে পারে।
ঢাকা মহানগর ফল আমদানি-রপ্তানিকারক ও আড়তদার ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুল করিম শেখ বলেন, ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় খেজুরের মতো ফল বেশি দামে আমদানি করতে হচ্ছে। ঋণপত্র (এলসি) খোলায়ও জটিলতা আছে। আমদানিতে যেটুকু খরচ বেড়েছে, খেজুরের দাম সেটুকু সমন্বয় করতে হচ্ছে।
সম্প্রতি সচিবালয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি জানান, কেউ উচ্চ লাভের আশায় মজুতদারি করছে কিনা এসব আমরা মনিটরিং করছি। এ কথা ঠিক যখন একটু সংকট হয় তখন অনেক সময় বড় করে সেটাকে দেখিয়ে কেউ কেউ সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করে। তবে বলতে চাই, পণ্য যথেষ্ট পরিমাণ মজুত রয়েছে। এলসি খোলার যথেষ্ট চেষ্টা চলছে। রমজান মাসে সমস্যা হবে না বলেই আমরা মনে করছি।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার যুগান্তরকে বলেন, অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে নিয়মিত বাজার তদারকি করা হচ্ছে। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বসে সবকিছু খতিয়ে দেখা হচ্ছে। অনিয়ম পেলে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না।