অপূর্ব আহমেদ জুয়েল ( বিশেষ প্রতিবেদনঃ ) বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের দিক থেকে ২০১৮ সালে সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষ আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে প্রাণ হারিয়েছে। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে। তাদের হিসাব অনুযায়ী ২০১৭ সালের তুলনায় গত বছর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বেড়েছে ২৮৭ শতাংশ।
২০১৮ সালে বাংলাদেশে মোট ৪৬৬ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে ২৯২ জন প্রাণ হারিয়েছে মাদকবিরোধী অভিযানের সময়। আর ২০১৭ সালে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিল ১৬২ জন। সেই হিসেবে এক বছরে বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ২৮৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
মাদক বিরোধী অভিযানের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের যেসব ঘটনা ঘটেছে তা তদন্ত করে দেখা প্রয়োজন যাতে জানা যাবে কোনো নিরপরাধ মানুষ এর শিকার হয়েছিল কি না। সার্বিকদিক বিবেচনায় বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি উদ্বেগজনক।
আসক ২০১৮ সালে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বেশকিছু তথ্য উত্থাপন করে। তাতে দেখা গেছে দেশে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৭৩২টি, ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৬৩ জনকে ও ৭ জন ধর্ষিতা আত্মহত্যা করেছে, ১,০১১ জন শিশু নিপীড়নের শিকার হয়েছে, নিপীড়নের পর হত্যার ঘটনা ঘটেছে ২৮৩টি ও আত্মহত্যা করেছে ১০৮ শিশু পুলিশের সংগে সংঘর্ষে নিহত হয়েছে ৬৭ জন নির্বাচনী সহিংসতায় নিহত হয়েছে ৩৪ জন। এরমধ্যে আওয়ামী লীগের ১৯ জন, বিএনপির ৪ জন ও সাধারণ মানুষ ছিল ১০ জন।
উদ্বেগজনক আরেকটি বিষয় হল নারী ও শিশু ধর্ষণের ঘটনায় অপরাধীদের সাজা হয় না উল্লেখ এই কারণে এরকম অপরাধ ঘটেই চলেছে। অপর এক তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ভোটের বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালের ১০ মাসে ২০১৭ সালের ১২ মাসের চেয়ে তিনগুন বেশি বিচারবহির্ভূত হত্যা হয়েছে৷
২০১৮ সালের মে মাসে শুরু হওয়া মাদকবিরোধী অভিযান নিয়ে বিতর্ক আছে৷ সেই বছরের ২৬ মে রাতে টেকনাফের কাউন্সিলর একরামুল হককে হত্যার পর এই অভিযান প্রশ্নের মুখে পড়ে৷ তারপর বেশ কিছুদিন অভিযান থমকে যায়৷ এরপর আবার নিহত হয় ১৩৮ জন আর গ্রেপ্তার হয় ১০ হাজারেরও বেশি৷ এই অভিযানে গ্রেপ্তারবাণিজ্য এবং টাকা না পেয়ে ‘ক্রসফায়ারের’ অভিযোগও আছে৷
মানবাধিকার কর্মীরা অনেক বছর ধরেই এই বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকলেও সরকার কখনোই তা খুব একটা আমলে নেয়নি৷ কেউ বিচারবহির্ভুত হত্যার শিকার হলেই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয় সে মাদকব্যবসায় সঙ্গে জড়িত ছিল৷ অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকলেই তো তাকে হত্যার কোন বিধান নেই। তাদের বিচারের আওতায় না এনে হত্যা করা সংবিধান, আইন ও মানবাধিকারের লঙ্ঘন৷ বিচার এড়াতে একটা শর্টকাট পথ বেছে নেওয়া হচ্ছে৷
এখন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের দু’টি স্টাইল দেখতে পাওয়া যায় এর একটা হলো বন্দুকযুদ্ধ এবং আরেকটা হলো লাশ উদ্ধার৷ লাশ উদ্ধারের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলেছে। এই পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে একটা সাময়িক উপশম পাওয়ার চেষ্টা করা হয়৷ আসলে তা শেষ পর্যন্ত কাজে আসে না৷ এছাড়া এটা নির্বাচনের আগে একটা ভয়ার্ত পরিবেশ সৃষ্টি করার অপকৌশল যাতে কোন প্রতিবাদী মানুষও কথা বলতে সাহস না পায়৷ শেষ পর্যন্ত সবাই এই ‘ক্রসফায়ার’ বা ‘বন্দুকযুদ্ধ’ প্রসঙ্গে জেনে শুনেও চুপ থাকে।