বাংলাদেশে বাক স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলাটা এই মুহুইর্তে বোধকরি সবচাইতে ঝুঁকির একটি বিষয়। কিন্তু ঝুঁকি যতই হোক বলতে হবেই এবং লেখা লেখি জারি রাখতে হবেই। আর এটি না করলে ফ্যাসিস্ট হাসিনা মনে করে নিবে সকলেই ভয় পেয়ে চুপ হয়ে গেছে ফলে সে তার ফ্যাসিস্ট শাষন কায়েম রাখতে পারবে।
আমরা একটি সমাজের বাক স্বাধীনতার স্বাধীনতার প্রতটি ব্যারোমিটার যদি বিবেচনা করে দেখি কিংবা মনে করবার চেষ্টা চালাই ঠিক কিভাবে বা কবে থেকে এই বাক স্বাধীনতার উপরে এম স্তীম রোলার চাপানোর পদ্ধতি তৈরী হোলো। এটি দেখতে গেলে আসলে আরেক স্বৈরাচার বপ্ররতমান প্রধানমন্ত্রীর পিতার দিকেই আলো নিক্ষেপ করতে হয়। যাই হোক আজকে আমরা মূল আলোচনাতে ফিরে আসি।
বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ নং অনুচ্ছেদের নামকে দুইভাবে ভাগ করা যায়: ১) চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা, ২) বাক স্বাধীনতা। ‘ভাব-প্রকাশের স্বাধীনতা’ এবং ‘সংবাদপত্রের স্বাধীনতা’ দুটোকে বাক-স্বাধীনতার মধ্যেই ফেলে দেয়া যায়।
সংবিধানের এই অনুচ্ছেদের প্রথমেই কোনো বিধিনিষেধ বা ‘সাপেক্ষে’ ছাড়াই ‘চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তাদান’ করা হয়েছে। কিন্তু বাকস্বাধীনতা, ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা বা মত প্রকাশের স্বাধীনতা বা সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে এভাবে নির্বিঘ্নে ছেড়ে দেয়া হয়নি। বরঞ্চ একটা বিরাট বাক্যের অধীনে এই স্বাধীনতাগুলোকে শর্তায়িত করে রাখা হয়েছে। শর্তগুলো হলো, ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা বা নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত-অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ-সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে…’
এই অনুচ্ছেদ খেয়াল করে পড়লে বোঝা যাচ্ছে, চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা দেয়া হলেও বাক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে বেড়াজালে আটকে রাখা হয়েছে। কিন্তু মুশকিল হলো, বাক স্বাধীনতা ছাড়া চিন্তার স্বাধীনতা আদৌ কি কোনো অর্থ বহন করে? ধরেন, আমি একটা বিষয় নিয়ে চিন্তা করছি, কিন্তু যতক্ষণ না পর্যন্ত সেই চিন্তাকে ভাষার মাধ্যমে হাজির করতে পারছি ততক্ষণ পর্যন্ত সেই চিন্তা কি আদৌ ‘চিন্তা’ হয়ে উঠতে পারবে? বা পেরেছে বলে কি আমি নিশ্চিত হতে পারি? উদাহরণস্বরূপ এই লেখাটার কথাই ধরা যাক। আমি সংবিধানের একটা ধারার প্যারাডক্স নিয়ে চিন্তা করছি, কিন্তু আমি যদি সেটা মৌখিক বা লিখিত রূপে ভাষার মধ্যে দিয়ে হাজির করতে না পারি তাহলে সেই চিন্তার অস্তিত্ব তো খুঁজে পাওয়া যাবে না। সেই চিন্তার থাকা বা না থাকাটা কি তখন তাৎপর্য বহন করে? চিন্তা বা চিন্তার বিষয়বস্তু পরীক্ষিত বা পরিশীলিত বা যুক্তির কঠিন ময়দানে অবতীর্ণ হওয়ার জন্য বা এমনকি ভুল প্রমাণিত হওয়ার জন্যও সেই চিন্তাকে প্রকাশ ঘটাতে হবে। সংবিধানের যে বিষয়টা আমার কাছে প্যারাডক্স মনে হচ্ছে, সেটা আমার বুঝতে ভুলও হতে পারে, সেটা নিয়ে বিস্তর তর্ক-বিতর্ক হতে পারে, কিন্তু সেই তর্ক-বিতর্ক তো হবে চিন্তার প্রকাশ ঘটার পর। মানে, মত প্রকাশের পর।
জে. বি. বিউরি যখন ‘চিন্তার স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাস’ লিখা শুরু করেন, তখন একেবারে গোড়াতেই ঘোষণা দেন, চিন্তার স্বাধীনতার ইতিহাস আসলে বাক স্বাধীনতারও ইতিহাসও বটে। ‘কথা বলার স্বাধীনতা বা মত প্রকাশের স্বাধীনতা ছাড়া চিন্তার স্বাধীনতা কোনো অর্থ বহন করে না’।
বিষয়টা তাহলে দাঁড়ালো এই, আমাদের সংবিধান বলছে আপনি চিন্তা করতে পারবেন স্বাধীনভাবে, কিন্তু সেই চিন্তার প্রকাশ করার বেলায় আপনি পরাধীন, শর্তায়িত। এখন, যে শর্তগুলোর কথা সংবিধানে সরাসরি উল্লেখ করা হয়েছে, মানে যেসব ব্যাপারে আপনার বাকস্বাধীনতা সীমিত সেগুলো হচ্ছে, ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তা’, ‘বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক’ , ‘জনশৃঙ্খলা’, ‘শালীনতা’ বা ‘নৈতিকতা’ ইত্যাদি। একটা উদাহরণের কথা ভাবা যাক। একজন গবেষক চিন্তা করলেন তিনি ভারতের সীমান্তে বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশী হত্যাকাণ্ড নিয়ে একটা গবেষণা করবেন। তিনি সেই গবেষণার চিন্তা করতেই পারেন, কেননা তিনি চিন্তায় স্বাধীন। কিন্তু, এখন ভারত যেহেতু আমাদের বন্ধুরাষ্ট্র গবেষকের সেই চিন্তার বহিঃপ্রকাশ বা গবেষণা প্রকাশিত হলে দুই রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটতে পারে, বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নষ্ট হতে পারে। বা, কোনো সংবাদপত্রে এমন কোনো রিপোর্টের বেলায় আমাদের রাষ্ট্র মনে করতেই পারে যে, এই রিপোর্ট প্রকাশিত হলে সম্পর্কের অবনতি ঘটবে। তখন আপনি সংবিধানের বেড়াজালে আটকা পড়ে গেলেন, আপনার গবেষণা তখন অ-সংবিধানিক। তো, এখন আপনি অনেক চিন্তা করলেন, গবেষণাও করলেন, কিন্তু যদি সেটা প্রকাশ করতে না পারেন তাহলে সেই ‘চিন্তা’র তাৎপর্য কি? এই প্রকাশ করাটাই হচ্ছে বাক স্বাধীনতা বা মত প্রকাশের স্বাধীনতা।
‘শালীনতা’ বা ‘নৈতিকতা’ ধারণাগুলোর ব্যাখ্যা এত বিস্তৃত এবং ক্ষমতা ও সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তনযোগ্য তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিছুদিন পূর্বে একজন বাউলের বিরুদ্ধে যে মামলা করা হয়েছিল, বা সিরাজাম মুনিরার বিরুদ্ধে যে মামলা করা হয়েছে, তারা যে সংবিধান বরখেলাপ করেছেন, তা শালীনতা বা নৈতিকতার বিস্তৃত ব্যাখ্যা দিয়ে প্রমাণ দেয়া সম্ভব বলে মনে হয়।
বর্তমানে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে যে আলোচনা চলছে, তাতে অনেকেই এই আইনকে সংবিধানের পরিপন্থী বলে দাবি করছেন। এটা যে সংবিধানের পরিপন্থী তা প্রমাণের জন্য তারা কেবল সংবিধানের ‘চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা’র কথা উল্লেখ করেন, এবং তারা আসলে এটাকেই বুঝিয়ে থাকেন বলে বিশ্বাস করি। কিন্তু, খেয়াল করে দেখবেন, সংবিধান চিন্তার স্বাধীনতা দিলেও সেই চিন্তাকে প্রকাশ করার স্বাধীনতা বিভিন্ন বেড়াজালে আটকে দিয়েছে। সে অনুযায়ী, ‘সংবিধান পরিপন্থী’ কথাটা পুরোপুরি কোনো অর্থ বহন করে না।
তো, এই ‘চিন্তা’র সাথে ‘চিন্তাকে হাজির করা’র মধ্যে যে দেয়াল তুলে দেয়া হয়েছে সেটা আসলে একটা জনগোষ্ঠীর সম্মিলিত চিন্তাকে, চিন্তার সম্ভাবনাকে নষ্ট করে দেয়। চিন্তা আসলে কোনো ‘ব্যক্তি’র বিষয় নয়, এটা আসলে ‘কালেক্টিভ’ বিষয়। তাই জ্ঞান উৎপাদন ও চর্চাও আসলে ‘কালক্টিভ’ বিষয়। আমার চিন্তা বহু জনের চিন্তার সাথে মিলবে, বহুজনের চিন্তা আমার চিন্তার সাথে মিলবে, মোলাকাত করবে, পরীক্ষা দিবে, খারিজ হবে, গৃহীত হবে – এমন বহু যৌথ কর্মকাণ্ডের মাধ্যমেই আসলে চিন্তাচর্চা এগিয়ে যায়। কিন্তু এই সব ‘কর্মকাণ্ড’ কেবল তখনই সম্ভব হবে যখন সেই চিন্তাকে হাজির করার স্বাধীনতা বজায় থাকবে। এটাই আসলে মত প্রকাশের স্বাধীনতা। এটাই আসলে বাক স্বাধীনতা। এটাই এর ফজিলত।
কিন্তু, বাংলাদেশের সংবিধান ‘চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা’র সাথে ‘বাক স্বাধীনতা’র একটা প্যারাডক্স হাজির করেছে। এখন আমার এই অনুমান বা সিদ্ধান্ত ভুল প্রমাণিত হতে পারে, কিন্তু আমি যদি সেটা প্রকাশ করতে নাই পারি, তাহলে কি আমার এই অনুমান (চিন্তা) কোনো অর্থ বহন করে?