কংগ্রেসের পথ ধরে বিএনপি


দৈনিক আলোড়ন
কংগ্রেসের পথ ধরে বিএনপি

২০২২ সালের ৭ সেপ্টেম্বর দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ুর কন্যাকুমারী থেকে ‘ভারতজোড়ো’ যাত্রা শুরু করেছিলেন কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী। প্রায় চার হাজার মাইলের এই যাত্রা শেষ হয়েছে চলতি বছরের ৩০ জানুয়ারি। কংগ্রেস নেতা রাহুলের নেতৃত্বে ভারতের ‘একতা রক্ষা’র যাত্রা যখন শেষদিকে, তখনই (গত ২৬ জানুয়ারি) ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার’ এবং ১০ দফা দাবি আদায়ে আচমকা ‘নীরব পদযাত্রা’র ঘোষণা দেয় বিএনপি।

বিএনপির অভ্যন্তরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দলের অভ্যন্তরীণ প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে ‘নীরব পদযাত্রা’র কর্মসূচি নির্ধারণ করে বিএনপি। কর্মসূচি নির্ধারণের আলোচনায় নেতারা পদযাত্রার কর্মসূচিতে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণের প্রত্যাশা করেন।

দায়িত্বশীল একাধিক সিনিয়র নেতা দৈনিক আলোড়ন কে জানান, দলের ‘নীরব পদযাত্রা’ কর্মসূচি নির্ধারণের আগে ভারতে রাহুল গান্ধীর ‘ভারতজোড়ো’ যাত্রার বিষয়টি তারা পর্যালোচনা করেছেন। কংগ্রেসের ভাবমূর্তি উদ্ধারে রাহুলের পদযাত্রায় ভারতের জনগণ দলটির আরও কাছাকাছি এসেছে বলেও মনে করেন বিএনপির নীতিনির্ধারকরা।

২৯ জানুয়ারি ভারতের শ্রীনগরে ‘ভারতজোড়ো যাত্রা’ শেষ হয়। পরদিন ৩০ জানুয়ারি সমাবেশের মধ্য দিয়ে কর্মসূচির সমাপ্তি হয়।

ভারতজোড়ো ওয়েবসাইট
২৯ জানুয়ারি ভারতের শ্রীনগরে ‘ভারতজোড়ো যাত্রা’ শেষ হয়। পরদিন ৩০ জানুয়ারি সমাবেশের মধ্য দিয়ে কর্মসূচির সমাপ্তি হয়।

‘ভারতজোড়ো’র ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, ‘এই যাত্রার লক্ষ্য ভারতকে একত্রিত করা, একত্রিত হতে এবং আমাদের জাতিকে শক্তিশালী করা।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির নেতারা বলছেন, ভারতকে একত্রিত রাখার দৃশ্যমান দাবি নিয়ে রাহুলের ‘ভারতজোড়ো’র মূল উদ্দেশ্য ছিল—কংগ্রেসকে সে দেশে উচ্চকিত করা। একইসঙ্গে সর্বশেষ নির্বাচনে হেরে রাহুলের রাজনৈতিক অবস্থান যে পর্যায়ে গেছে, সেখান থেকে উঠে আসার পথটিকে দৃঢ় করা। সেদিক থেকে বিএনপির লক্ষ্য মূলত ভিন্ন।

দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদের পর্যবেক্ষণ—‘ভারতের পরিপ্রেক্ষিত আর বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিত এক নয়। রাহুল গান্ধী ভারতে তার দল কংগ্রেসের রিভাইভালের জন্য পদযাত্রা করেছেন। ভারতে নির্বাচনি প্রক্রিয়ায় ঝামেলা নেই। কিন্তু বিএনপি যে নীরব পদযাত্রার ঘোষণা করেছে—সেটি হচ্ছে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য, ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। অ্যাজ এ পার্টি—বিএনপি দেশের নির্বাচনি প্রসেস ঠিক করতেই যুগপৎভাবে পদযাত্রা কর্মসূচি পালন করছে।’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কামরুল আহসান মনে করেন, ‘ভারত থেকে বিএনপির প্রভাবিত হওয়ার সম্ভাবনা কম।’ তিনি বলেন, ‘আসলে এগুলো (নীরব পদযাত্রা) কিছুটা অহিংস আন্দোলনের পদ্ধতি। বিএনপি গত এক বছর ধরে তাদের মহাসমাবেশসহ আন্দোলনগুলো অহিংসভাবে করে আসছে। হয়তো সময়ের বিবেচনায় এটাকে ভালো পন্থা মনে হয়েছে।’

ড. মোহাম্মদ কামরুল আহসানের ভাষ্য—সাধারণ মানুষ বিশেষত, এই প্রজন্ম অহিংস আন্দোলন পছন্দ করে। মানুষের চাহিদার বিবেচনায় বিএনপি মনে করে যে এই আন্দোলনটি জনসম্পৃক্ততার জন্য ভালো। এতে দুর্ভোগও নেই।’

এ বছরের ২৬ জানুয়ারি ঘোষণার পর ২৮ জানুয়ারি বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে রাজধানীর বাড্ডা থেকে মালিবাগের আবুল হোটেল পর্যন্ত সোয়া চার কিলোমিটার পথ ‘নীরব পদযাত্রা’ করে বিএনপি। বিএনপির মহাসচিব সেখানে উল্লেখ করেন—নীরব পদযাত্রার মধ্য দিয়ে নতুন আন্দোলন শুরু করেছে বিএনপি।

ক্রমান্বয়ে ঢাকায় মোট চারটি পদযাত্রা করে বিএনপি। এরই ধারাবাহিকতায় গত ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকার সমাবেশ থেকে মির্জা ফখরুল ঘোষণা করেন—১১ ফেব্রুয়ারি সারা দেশের ইউনিয়ন পর্যায়ে পদযাত্রা হবে। বিএনপির সঙ্গে সরকারবিরোধী আরও বেশ কয়েকটি দলও নীরব পদযাত্রার কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। ১১ ফেব্রুয়ারি যুগপৎভাবে এই কর্মসূচি পালন করবে দলগুলো।

যুগপৎ ধারায় বিএনপির সঙ্গে রয়েছে সাত দলীয় জোট গণতন্ত্র মঞ্চ। এই জোটের নেতারাও মনে করছেন— ভারতে রাহুলের পদযাত্রা যেমন দেশটির রাজনীতিতে নতুন উপাদান যুক্ত করেছে, তেমনি বাংলাদেশেও জনগণ সরকারের বিরুদ্ধে এই আন্দোলনে সম্পৃক্ত হবে, সাড়া দেবে।

এ প্রসঙ্গে গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম নেতা, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘আমরা আমাদের স্বাধীন অবস্থান থেকে পদযাত্রার কর্মসূচি ঘোষণা করেছি। আরও লক্ষণীয় যে দেশের রাজনীতিতে আমরা নানা উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত থেকে এ ধরনের কর্মসূচি আগেও পালন করেছি।’

‘জাতীয় সম্পদ রক্ষায় রোডমার্চ, পদযাত্রা করেছি’ উল্লেখ করে সাইফুল হক বলেন, ‘পদযাত্রার মাধ্যমে বেশি সংখ্যক মানুষকে যুক্ত করার সম্ভাবনা অনেক। মানুষের আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে আমরা পদযাত্রা শুরু করেছি। ‘ভারতজোড়ো’ যাত্রা ভারতে নতুন ইমপ্যাক্ট তৈরি করেছে, নতুন উপাদান যুক্ত করেছে দেশটির রাজনীতিতে।’

গত ২৯ জানুয়ারি প্রায় পাঁচ মাস ধরে ১২টি রাজ্যের মধ্য দিয়ে প্রায় চার হাজার কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে জম্মু-কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগরে জনসভার মধ্য দিয়ে রাহুল গান্ধীর পদযাত্রা কর্মসূচি শেষ হয়। পরদিন ৩০ জানুয়ারি সমাবেশের মধ্য দিয়ে কর্মসূচির সমাপ্তি টানেন রাহুল।

বিএনপি ও যুগপতে যুক্ত নেতারা জানিয়েছেন, আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নীরব পদযাত্রাও একটি লক্ষ্যে এগিয়ে যাবে। ১১ ফেব্রুয়ারি ইউনিয়ন পর্যায়ে পদযাত্রার পর ক্রমান্বয়ে তা উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে পালন করা হতে পারে।

জানতে চাইলে বিএনপির ফরেন রিলেশন্স কমিটির প্রধান ও স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের পদযাত্রা আর ভারতজোড়োর মধ্যে মৌলিক পার্থক্য হচ্ছে বিষয়ে। প্রথম কথা হচ্ছে—ভারতে নির্বাচিত সরকার আছে। দেশটিতে রাজ্য সরকারগুলোও নির্বাচিত। অপরদিকে আমাদের দেশে আওয়ামী লীগ জোর করে ক্ষমতা দখল করে আছে। আমাদের পদযাত্রার লক্ষ্য—দেশের মালিকানা জনগণের হাতে ফিরিয়ে দেওয়া।’

আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী উল্লেখ করেন, আমাদের দেশে মানুষের ভোটাধিকার নেই, দেশে আইনের শাসন নেই, বাকস্বাধীনতা নেই, সাংবিধানিক অধিকারগুলো কেড়ে নিয়েছে সরকার। সেদিক থেকে ভারতের ‘ভারতজোড়ো’র ইস্যু এক নয়, তাদের প্রসঙ্গ আদর্শিক।

তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশ তো মানুষের হাতে নেই। আমরা মানুষের কাছে দেশ ফিরিয়ে দেওয়ার সংগ্রাম করছি।’

প্রকাশক: অপূর্ব আহমেদ জুয়েল