
হাসিনা-পরবর্তী বাংলাদেশে দুর্নীতির বিস্ফোরণ: সরকার বদলেছে, দুর্নীতি নয়
অনুসন্ধানী সাংবাদিক ও রাজনৈতিক কলামিস্টঃ অপুর্ব আহমেদ জুয়েল
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব পরিবর্তন ঘটে। দীর্ঘদিনের ক্ষমতাসীন শেখ হাসিনার পতন ও নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উত্থান— এই মুহূর্তটি বাংলাদেশের জন্য এক নতুন আশার আলো হিসেবে দেখা হয়েছিল। জনগণ ভেবেছিল, বহু বছরের প্রশাসনিক দুর্নীতির অন্ধকার থেকে এবার মুক্তি মিলবে।কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই ছবিটা স্পষ্ট হয়েছে—সরকার বদলেছে, দুর্নীতি নয়।
দুর্নীতি বরং আরও বিস্তৃত হয়েছে, আরও আক্রমণাত্মক হয়েছে, আরও নিয়ন্ত্রণহীন আকার ধারণ করেছে।
১. আন্তর্জাতিক সূচকে বাংলাদেশের ভয়াবহ পতন
Transparency International-এর CPI 2024 রিপোর্টে বাংলাদেশের অবস্থান:
এই সূচক শুধু প্রশাসনিক ব্যর্থতার প্রকাশ নয়; এটি দেখায় দুর্নীতি দমন ও জবাবদিহিতার ক্ষেত্রে রাষ্ট্র কতটা দুর্বল হয়ে পড়েছে।
সাবেক মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল বলেছেন—
“সরকার পরিবর্তন মানেই দুর্নীতি কমে না—দুর্নীতির ব্যবস্থাটা ভাঙতে হয়। সেটা হয়নি।”
২. কেন্দ্রীয় দুর্নীতি ভেঙে ‘অরাজক দুর্নীতি’তে রূপান্তর শেখ হাসিনার সময় দুর্নীতি ছিল কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত। তবে নতুন সরকারের অস্থিরতা ও দুর্বল প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণে এখন দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছে প্রতিটি স্তরে।
এখন দুর্নীতি দেখা যাচ্ছে:
প্রশাসনের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন—
“আগে দুর্নীতির রেট নির্ধারিত ছিল; এখন যার যত চাই তত নিচ্ছে।”
এই ‘Fragmented Corruption’ আরও ভয়ংকর, কারণ এটি নিয়ন্ত্রণহীন।
৩. ড. ইউনুস সরকারের সীমাবদ্ধতা: প্রশাসনে নেতৃত্বের অভাব
নবগঠিত সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ— প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং নীতি কার্যকর করার অভিজ্ঞতা।
অস্থায়ী সরকার হওয়ায়:
এই রাজনৈতিক দুর্বলতা দুর্নীতিবাজদের চোখে সুযোগ তৈরি করেছে। একজন জেলা প্রশাসক বেনামে বলেন—
“লিডারশিপ দুর্বল, আর সেই জায়গায় দুর্নীতি এখন নিজের গতিতে চলছে।”
৪. মেগা প্রকল্পে আগের দুর্নীতির ছায়া অপরিবর্তিত
প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধি, নিম্নমানের কাজ, দরপত্রে লুকানো কমিশন—
এই সমস্যাগুলো ক্ষমতা বদলের পরও রয়ে গেছে আগের মতোই।
বিশ্বব্যাংক ও ADB একাধিক রিপোর্টে জানিয়েছে—
এ থেকে পরিষ্কার— মেগা প্রকল্প দুর্নীতি এখনো অচলাবস্থায়।
৫. দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে তদন্ত নেই—জবাবদিহিতাও নেই
দীর্ঘদিন ধরে জনগণের দাবি ছিল—
এসব বড় মামলার তদন্ত হবে। কিন্তু নতুন সরকার এসে এর আগের মতোই নীরব।একটিও বড় দুর্নীতির তদন্ত সম্পূর্ণ হয়নি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন—
“বাংলাদেশে দুর্নীতি ব্যক্তি নির্ভর নয়; এটি একটি পচা কাঠামো। মুখ বদলে কাঠামো বদলায় না।”
৬. দুর্নীতির চাপে সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ
প্রশাসনিক দুর্নীতির কারণে:
অর্থাৎ দুর্নীতির সবচেয়ে বড় বোঝা বহন করছে সাধারণ মানুষ।
৭. গণতন্ত্রহীন পরিবেশ—দুর্নীতির সবচেয়ে বড় সহায়ক
বাংলাদেশে বর্তমানে—
এই অগণতান্ত্রিক পরিবেশ দুর্নীতিকে আরও উৎসাহিত করছে।
শেষ কথা: পরিবর্তন হয়নি বাস্তবতায়, পরিবর্তন হয়েছে শুধু ক্ষমতায়
২০২৪ সালের রাজনৈতিক পরিবর্তন একটি নতুন আশার জন্ম দিলেও, দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেই আশা বাস্তবে রূপ নেয়নি।
বাংলাদেশের দুর্নীতি কমেনি— বরং আরও শক্ত হয়েছে, আরও বিস্তৃত হয়েছে, আরও নিয়মহীন হয়েছে। যদি এখনই শক্তিশালী প্রশাসনিক সংস্কার, জবাবদিহিতা ও স্বাধীন তদন্ত না হয়— তাহলে এই পরিবর্তনও ইতিহাসে কেবল ব্যর্থ প্রত্যাশা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।