পুরান ঢাকায় ঝুঁকিপূর্ণ ভবন রয়েছে কয়েক হাজার। আর এলাকাটির গলিগুলোর অধিকাংশ ভবনে রয়েছে প্লাস্টিকসহ বিভিন্ন পণ্য তৈরির কারখানা, রাসায়নিক গোডাউন। ভবনগুলোর অনুমোদন আছে কি-না; থাকলেও বিল্ডিং কোড মেনে তৈরি কি-না তা জানতে পারছে না ভাড়াটিয়া কিংবা ব্যবহারকারীরা। এমন একটি অবস্থার মধ্যেই ওই এলাকায় কয়েক লাখ মানুষের বসবাস। কিন্তু এ ব্যাপারে বছরের পর বছর নির্বিকার সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো। দুর্ঘটনা ঘটলে কিছুদিন তোড়জোড় দেখা যায়। এরপর আগের মতোই।
জানা যায়, পুরান ঢাকার ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো আবাসিক, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়, হাসপাতাল হিসাবে ব্যবহার হচ্ছে। সবসময় ১০ জন থেকে শুরু করে শতাধিক লোকও একেকটি ভবনে অবস্থান করেন। এখন যে ভবনগুলো নির্মাণ হচ্ছে সেগুলোও বিল্ডিং কোড মেনে নির্মান হচ্ছে না। সাত মাত্রার ভ‚মিকম্প হলে ঘিঞ্জি এলাকার এসব ভবন লন্ডভন্ড হয়ে যাবে। প্রাণ যাবে হাজার হাজার মানুষের। কয়েক বছর আগে সিটি করপোরেশন ও রাজউক ভবনগুলোতে ঝুঁকিপূর্ণ লেখা সাইনবোর্ড লাগিয়েই দায় সেরেছে। এছাড়া কিছু পুরোনো ভবনকে হেরিটেজ হিসাবে ঘোষণা করে ভাঙ্গায় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত।
সূত্র জানায়, পুরান ঢাকার শাঁখারীবাজার, তাঁতীবাজার, টিপু সুলতান রোড, নারিন্দা, নবাবগঞ্জ রোড, লালবাগ, খাজে দেওয়ান, চকবাজার, মিটফোর্ড, ইসলামপুর, জিন্দাবাহার, কসাইটুলি, নাজিরা বাজার, কাপ্তানবাজার, সাতরওজা, সূত্রাপুর, হাজারীবাগ, চকবাজার, বংশাল, কোতোয়ালি, শ্যামপুর ও কামরাঙ্গীরচরে কয়েক হাজার জরাজীর্ণ ঝুঁকিপূর্ণ পরিত্যক্ত ভবন রয়েছে।
এসব এলাকায় শত বছর কিংবা কয়েকশ বছর পুরোনো জরাজীর্ণ ভবনে বংশ পরম্পরায় মানুষ বসবাস করে আসছে। ভবনগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো -স্যার সলিমুলাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতালের এডওয়ার্ড বিল্ডিং। এছাড়া এই হাসপাতালের অভ্যন্তরে আরও কয়েকটি অতি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে কর্মচারীরা বসবাস করছেন।
এছাড়া লক্ষীবাজার শহিদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের ৭৩ বছরের পুরোনো ও ঝুঁকিপূর্ণ একটি ভবনে শিক্ষার্থীদের পাঠদান দেওয়া হচ্ছে। এই ভবনটির অবস্থা করুণ। ছাদের পলেস্তারা খসে পড়ছে। বেরিয়ে পড়েছে রড। জানালার দেওয়ালেও ভাঙন। শিক্ষার্থীরা বলছেন, প্রায়ই তাদের ওপর খসে পড়ে পলেস্তারা। বাধ্য হয়েই ঝুঁকিপূর্ণ এই ভবনে ক্লাস করছেন তারা।
কয়েক বছর আগে পুরান ঢাকার ৫৭৩টি ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়। এর মধ্যে ১৪৫টিকে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ। এরমধ্যে সূত্রাপুর থানায় ১৪৬টি, কোতোয়ালিতে ১২৬টি, হাজারীবাগে ২১টি, লালবাগে ৭৩টি ও শাঁখারীবাজারে ৯১টি। আতঙ্কের বিষয় হলো পুরান ঢাকার দুইশ থেকে আড়াইশ বছরের পুরোনো ভবনের সংখ্যা পঁচিশটিরও বেশি। পরিস্থিতি বুঝে বিত্তশালীরা ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ভাড়া দিয়ে অন্যত্র বসবাস করছেন। কিন্তু অল্পভাড়ায় পেয়ে এসব ভবন ভাড়া নিচ্ছেন অনেকে। এদিকে প্রাচীন ঐতিহ্য হিসাবে চিহ্নিত ও সংরক্ষিত ভবনগুলো নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো দিকনির্দেশনা না থাকায় এগুলোর কী হবে, তা পরিষ্কারভাবে কেউ কিছু বলতে পারছেন না। আবাসন খাতের বেসরকারি উদ্যোক্তারা বলছেন, সরকার চাইলে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন অপসারণ করে সেখানে নতুন ভবন তৈরিতে তারা সহায়তা দিতে প্রস্তুত। আর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঐতিহ্যবাহী ভবনগুলো সংস্কার ও সংরক্ষণের ক্ষেত্রে বিশ্বের অন্যান্য দেশের পথ অনুসরণ করা যায়। এ ক্ষেত্রে ‘আরবান রিজিওনাল প্রজেক্ট’ ধরে কাজ করা যেতে পারে। তবে পুরোনো ভবনগুলো নিয়ে বেশ বিপাকে পড়েছেন মালিকরা। আদালতের নিষেধাজ্ঞায় এসব ভবন মেরামত কিংবা তা ভেঙে নতুন ভবন নির্মাণ করতে পারছেন না তারা।
হাজি আলি হোসেন, সরোয়ারসহ কয়েকজন ভবন মালিক যুগান্তরকে বলেন, বাপ-দাদার ভিটা-মাটিতে থাকা বসতবাড়ি কিভাবে ঐতিহাসিক স্থাপনা হয় তা বুঝি না। সবাই বাসা-বাড়ি পুরাতন হলে ভেঙে নতুন করে নির্মাণ করতে পারে। কিন্তু আমরা এ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছি। উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকায় নির্মাণকাজ করতে পারছি না। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানাই।
ভ‚তাত্তি¡ক গবেষণা বলছে, ঢাকা শহর ভ‚মিকম্পের জন্য ভয়ানক ঝুঁকিপূর্ণ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হচ্ছে পুরান ঢাকা। সাত মাত্রার কম্পন হলে পুরান ঢাকার ঘিঞ্জি এলাকা লন্ডভন্ড হয়ে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটবে। জরাজীর্ণ ভবনে বসবাসকারী কয়েকজন ভাড়াটিয়া বলেন, বহু পুরাতন ভবন ভেঙে নতুন ভবন নির্মাণ করতে গেলে নানান বিপত্তি। একটি ভবন আরেকটির সঙ্গে গা-লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এছাড়া গোটা এলাকা ঘিঞ্জি। তাই একটি ভবন ভাঙতে গেলে আরেকটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়বে। নতুন ভবন গড়তে দিলে ঠাঁই নেওয়ার মতো জায়গা পাব কই। এদিকে ৩০-৫০ বছরের পুরোনো ভবনের মালিকরা ভবন ভেঙে নতুন করে ভবন বানাতে রাজিও নয়।
এদিকে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) একটি জরিপ রিপোর্টে বলা হয়েছে, রাজধানীতে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজার। এর মধ্যে ৩২১টি অধিক ঝুঁকিপূর্ণ। বাকি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো দীর্ঘদিন ধরে আগের অবস্থায় রয়েছে। এসব ভবনের অধিকাংশই পুরান ঢাকার উলিখিত এলাকাগুলোয়। গত বছর নতুন করে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা করে রাজউক। কিন্তু সেই তালিকায় কতগুলো ভবনকে চিহ্নিত করা হয়েছে তা স্পষ্ট করেনি রাজউক কর্তৃপক্ষ। রাজউকের নগর পরিকল্পনা শাখার একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, নগরীর ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের পুরোনো যে তালিকা ছিল, সেটা ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছিল। কিন্তু তারা এ ব্যাপারে এখনো কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। তিনি জানান, ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোর তালিকার বিষয়ে তারা ব্যবস্থা নেবেন কি নেবেন না এটা তাদের ব্যাপার। এছাড়া রাজউক কর্তৃক ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলে যে জনবল দরকার তা নেই। যে কারণে তালিকা থাকার পরও ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তবে অপর একটি সূত্র জানায়, ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলে অনেক সময় বাধার সম্মুখীন হতে হয়। কখনো উপরমহলের অনুরোধ রাখতে গিয়ে তালিকায় থাকার পরও কিছু করা সম্ভব হয় না।
এসব বিষয়ে জানতে রাজউক চেয়ারম্যান আনিসুর রহমান মিঞার মোবাইল ফোনে বার বার কল করা হয়েছে। কিন্তু তিনি রিসিভ করেনি।
এডওয়ার্ড বিল্ডিংয়ের বিষয়ে জানতে চাইলে স্যার সলিমুলাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রাশিদুন নবী যুগান্তরকে বলেন, বিল্ডিংটি ঝুঁকিপূর্ণ নয়, কয়েক বছর আগে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করার পর আবারও টেকনিক্যাল কমিটি বসে রিপিয়ারিং করে বলেছে তিন বছর ব্যবহার করা যাবে। ২০২২ সালে কমিটি এই সিদ্ধান্ত দিয়েছে।
এ কারণেই ভবনটি ব্যবহার করা হচ্ছে। কয়েকটি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে কর্মচারীরা বসবাস করছেন স্বীকার করে তিনি বলেন, এসব ভবনে যারা থাকছেন, তাদেরকে বারবার সতর্ক করা হচ্ছে। এরপরও তারা ভবন ছাড়ছেন না।