তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) শিক্ষার্থী ও স্থানীয়দের মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।
এ ঘটনায় দফায় দফায় সংঘর্ষে সাংবাদিকসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত তিন শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। আহতদের অনেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন।
এছাড়া গুরুতর আহতদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস ও অ্যাম্বুলেন্সযোগে উন্নত চিকিৎসার জন্য রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
এর আগে শনিবার সন্ধ্যা ৬টা রাত পৌনে ১১টা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বিনোদপুরর বাজারের স্থানীয় দোকানদার ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের ধাওয়া, পাল্টা ধাওয়া চলে। এদিন সংঘর্ষ, আগুন ও ইটপাটকেল ও রাবার বুলেটের আঘাতে রণক্ষেত্রে পরিনত হয় বিনোদপুর বাজার।
এদিন স্থানীয়রা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীরের বাহির থেকে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্য করে ইট পাটকেল নিক্ষেপ করেন। পাল্টা আক্রমনে রাবি শিক্ষার্থীরাও স্থানীয়দের লক্ষ্য করে প্রাচীরের ভেতর থেকে বাইরে ইটপাটকেল ছুড়েন।
এছাড়া বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা বিনোদপুর পুলিশ ফাঁড়িসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীর ঘেঁষে থাকা দোকানগুলোতে আগুন লাগিয়ে দেন। এতে বিনোদপুর বাজারের আটটি দোকান সম্পূর্ণভাবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের বিনোদপুর গেট সংলগ্ন পুলিশ ফাঁড়ি আংশিক পুড়ে গেছে।
এদিকে শনিবার রাতে দ্বিতীয় দফায় সংঘর্ষ চলাকালীন পুলিশ রাবার বুলেটসহ গুলি চালিয়েছেন বলে অভিযোগ তুলেছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এদিন রাত সোয়া ১০টায় মসজিদে মাইকিং করে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দ্বিতীয় দফায় সংঘর্ষে জড়ায় স্থানীয়রা। এসময় শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিনোদপুর গেট থেকে স্থানীয়দের লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়েন। শিক্ষার্থী ও স্থানীয়দের ছত্রভঙ্গ করতে এসময় রাবার বুলেট ও টিয়ারগ্যাস ছুড়ে পুলিশ। রাবার বুলেটের আঘাত এসময় অন্তত ১৫জন শিক্ষার্থী নতুন করে আহত হয় বলে জানা গেছে।
সংঘর্ষের ঘটনায় সবমিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক সুলতান-উল-ইসলাম। এছাড়া একজন স্থানীয় আহত হওয়ার খবর জানা গেছে।
সংঘর্ষের ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শেখ ইউসুফ বাপ্পী, ইমরান, রেদওয়ান, হাসিব, সুরুজ, শাহীন, সমাপ্ত, ফুয়াদ, লিখন, মীর কাদীর, মিহাদসহ এ পর্যন্ত ৮৪ জন শিক্ষার্থী রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরী বিভাগের বিভিন্ন ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এছাড়া প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে অনেকে ক্যাম্পাসে ফিরেছেন।
এদিকে এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে বিনোদপুরসহ আসপাশের এলাকাগুলোর মেসে অবস্থানরত শিক্ষার্থীরা প্রচুর নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন বলে জানা গেছে। অনেক মেসের জানালায় স্থানীয়দের ইট পাটকেল ছোড়ার পাশা গেট ভেঙ্গে মেসে প্রবেশ শিক্ষার্থীদের বাইরে থেকে অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজের ঘটনাও জানা গেছে। আবার একই ঘটনার জেরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা চারুকলায় গাছ ফেলে রেলপথ বন্ধ করে দিয়েছেন বলে জানা গেছে।
এদিন প্রথম দফায় সংঘর্ষ চলাকালীন শনিবার রাত ৯টায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে টিয়ারসেল ছুড়ে পুলিশ। এসময় বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের অনেকে ছত্রভঙ্গ হয়ে ক্যাম্পাসে ফিরে আসলে বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা কেন্দ্রের সামনে বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য ও উপ-উপাচার্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্বশরীরে দেখা করেন।
এসময় উপাচার্য আগামী দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল ক্লাস-পরীক্ষা স্থগিতের ঘোষণা দেন। যদিও ক্লাস-পরীক্ষা চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে রয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এছাড়া এদিন রাত সাড়ে আটটায় ঘটনাস্থলে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন এসে উভয়পক্ষকে শান্ত থাকতে অনুরোধ করেন। এর পরবর্তীতে আবার দ্বিতীয় দফায় সংঘর্ষ শুরু হয়।
জানা গেছে, বগুড়া থেকে ইসলাম ট্রাভেলসের বাসে রাজশাহী আসছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৭-১৮ সেশনের শিক্ষার্থী আলামিন আকাশ। বাসে সিটে বসাকে কেন্দ্র করে গাড়ির ড্রাইভার শরিফুল ও কন্ডাক্টর রিপনের সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয় আকাশের। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিনোদপুর গেট এসে আবারও কন্ডাক্টারের সঙ্গে ঝামেলা বাধে। তখন স্থানীয় এক দোকানদার এসে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তর্কে জড়ান। একপর্যায়ে তাদের মধ্যে ধাক্কাধাক্কির ঘটনা ঘটে। এসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা ঘটনাস্থলে জড়ো হন এবং স্থানীয় দোকানদারে ওপর চড়াও হন।
বিষয়টির মীমাংসা করতে ঘটনাস্থলে রাবি শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি গোলাম কিবরিয়া গেলে তার বাইকে আগুন লাগিয়ে দেন স্থানীয়রা।
স্থানীয়দের হামলায় আহত রাবির গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী আল জাবের আহমেদ বলেন, বাসের কন্ডাক্টর ও স্থানীয়দের হামলা থেকে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রকে রক্ষা করতে ঘটনাস্থলে যাই। এ সময় তারা আমাদের ওপর হামলা করে। এতে আমাদের শতাধিক ছাত্র আহত হয়েছেন। আমরা সবাই হাসপাতালে এসেছি চিকিৎসা নিতে।
চারুকলা অনুষদের আহত শিক্ষার্থী আকাশ জানান, আমি রাস্তার ওপরে ছিলাম, হঠাৎ স্থানীয়রা আক্রমণ করেন। এলোপাতাড়ি মারতে থাকে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টার সূত্রে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত মাথা, হাত-পায়সহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে ক্ষত নিয়ে শতাধিক শিক্ষার্থী চিকিৎসাধীন। অনেক প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন। গুরুতর আহত প্রায় শতাধিক শিক্ষার্থীকে রাজশাহী মেডিকেল হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। এদের মধ্যে অনেকের প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। আবার অনেকে রাবার বুলেটের আঘাতে আহত হয়েছেন।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে উপাচার্যের বরাত দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দপ্তরের প্রশাসক অধ্যাপক প্রদীপ কুমার বলেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বর্তমানে পাঁচ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েনের পাশাপাশি প্রচুর সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য সকল শিক্ষার্থীদের শান্ত থাকার অনুরোধ জানিয়েছেন।
গুলি ছোঁড়ার বিষয়ে জনসংযোগ প্রশাসক বলেন, এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি বলে পুলিশ প্রশাসন থেকে আমাদের জানানো হয়েছে। তবে টিয়ারগ্যাস ও রাবার বুলেট ছোড়ার বিষয়টি জেনেছি। আহতদের চিকিৎসার বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের পক্ষ থেকে দেখা হচ্ছে।
এদিকে ঘটনাস্থলে পুলিশ এবং র্যাবের পাশাপাশি বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে বলে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন রাজশাহী বিজিবি-১ ব্যাটেলিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাব্বির আহমেদ। তিনি জানান, ঘটনস্থলে সাত প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। তারা রাজশাহী ঢাকা মহাসড়কের বিনোদপুরে অবস্থান করছেন।
এ বিষয়ে মহানগর পুলিশের মুখপাত্র অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার রফিকুল ইসলাম জানান, ঘটনাটি জানার পরপরই সংশ্লিষ্ট থানা ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেখানে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। তারা কাজ করছে।
নগর পুলিশ কমিশনার আনিসুর রহমান বলেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনতে পুলিশ কিছু টিয়ারসেল নিক্ষেপ করেছে। ছাত্ররা বেশ কয়েকটি দোকান পুড়িয়েছে। ছাত্রদের বিষয় বেশ স্পর্ষকাতর। তাই সাবধানে নিয়ন্ত্রণ করতে হচ্ছে।