বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক দফা কর্মসূচি ঘিরে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নজীরবিহীন সংঘর্ষ ও সহিংসতা হয়েছে। রোববার (৪ আগস্ট) রাত ১১টার দিকে এই প্রতিবেদন লেখার সময় ৯৬ জনের মৃত্যুর সংবাদ নিশ্চিত হওয়া গেছে।
এরমধ্যে সিরাজগঞ্জে ২২ জন নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে জেলার এনায়েতপুর থানার ১৩ জন পুলিশ সদস্য রয়েছে। এছাড়া, লক্ষ্মীপুরে ১১, ফেনী ৮, নরসিংদী ৬, কিশোরগঞ্জ ৬, মাগুরা ৪, রংপুর ৪, বগুড়া ৪, মুন্সীগঞ্জ ৩, কুমিল্লা ৩, শেরপুর ৩, সিলেট ৪, পাবনা ২, জয়পুরহাটে ২ এবং ভোলা, হবিগঞ্জ, কক্সবাজার, সুনামগঞ্জ, বরিশাল ও গাজীপুরের শ্রীপুর ও সাভারে একজন করে নিহত হয়েছেন।
এছাড়া, রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষে সাতজন নিহত হয়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে একজন ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটি, একজন হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজের শিক্ষার্থী রয়েছে বলে জানা গেছে।
সিরাজগঞ্জে তেরো পুলিশ সদস্যকে হত্যা
সিরাজগঞ্জ জেলায় ১৩ পুলিশ সদস্যসহ ২২ জন নিহত হয়েছেন। সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানায় ঢুকে তেরো জন পুলিশ সদস্যকে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। রোববার বিকেলের দিকে এ ঘটনা ঘটে। তবে তাৎক্ষণিকভাবে নিহত পুলিশ সদস্যদের পরিচয় পাওয়া যায়নি। বিষয়টি নিশ্চিত করেছে রাজশাহী রেঞ্জের ডিআইজির কার্যালয়।
নরসিংদীতে নিহত আওয়ামী লীগের ৫ নেতাকর্মীসহ নিহত ৬
নরসিংদীর মাধবদিতে আন্দোলনকারীদের গণপিটুনিতে আওয়ামী লীগের ৫ নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন। রোববার (৪ আগস্ট) দুপুর ১টার দিকে উপজেলার পৌরসভা মোড় এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। এছাড়া জেলায় আরও একজন নিহত হয়েছেন।
নিহতরা হলেন, মাধবদী থানার চরদিঘলদী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন শাহীন (৩৬), সদর উপজেলা চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেনের ছোটভাই ছাত্রলীগ নেতা দেলোয়ার হোসেব দেলু, জেলা পরিষদের সাবেক সদস্য মনিরুজ্জামান ভুইয়া (৪৫), পৌরসভার ১১ নং ওয়ার্ডের সদস্য বাবুল, আওয়ামী লীগের কর্মী কামাল মিয়া (৪৫)।
জানা গেছে, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের মাধবদি এলাকায় জড়ো হয়ে বিক্ষোভ শুরু করে আন্দোলনকারীরা। পরে তারা মাধবদি সদরে প্রবেশের চেষ্টা করে। এ সময় স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা পৌরসভা মোড়ে জড়ো হয়। আন্দোলনকারীদের ঠেকাতে তাদের ধাওয়া ও গুলি ছোঁড়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। এ সময় ৮-১০ জন আন্দোলনকারী গুলিবিদ্ধ হয়। পরে, ক্ষিপ্ত হয়ে আন্দোলনকারীরা আবারও মাধবদী বাসস্ট্যান্ড এলাকায় পৌরসভার সামনে জড়ো হয়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা করে । এ সময় তাদের গণপিটুনিতে মারা যায় ৫ আওয়ামী লীগ নেতা।
ফেনীতে নিহত ৮:
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা অসহযোগ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ফেনীর মহিপালে গুলিতে ৫ জন নিহত হয়েছে। এছাড়া আহত হয়েছে ৫০ জন। ফেনী জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার আসিফ ইকবাল ৫ জনের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। আশংকাজনক অবস্থায় অনেককে ঢাকা ও চট্টগ্রামে পাঠানো হয়েছে। এছাড়াও, রোববার সন্ধ্যার পর আরও তিনজন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
মাগুরায় ছাত্রদল নেতাসহ নিহত ৪:
সকাল থেকেই উত্তপ্ত মাগুরা। দফায় দফায় আন্দোলনকারীদের সাথে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে গুলিতে মেহেদী হাসান রাব্বি নামে একজন নিহত হয়েছেন। এছাড়াও পুলিশ সাংবাদিকসহ অন্তত ২৫ জন আহত হবার খবর পাওয়া গেছে। নিহত রাব্বি মাগুরা জেলা ছাত্রদলের সহ-সভাপতি বলে কয়েকটি সূত্র নিশ্চিত করেছে।
আন্দোলনকারীরা রোববার সকাল সাড়ে ১০টায় পারনান্দুয়ালী এলাকায় ঢাকা-খুলনা মহাসড়ক ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রবেশদ্বার ভায়নার মোড়ে অবস্থান নেয়। অভিযোগ, এ সময় তাদের বিক্ষোভ সমাবেশে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা অস্ত্র নিয়ে হামলা চালায়। এক পর্যায়ে গুলিতে রাব্বি নিহত হন। এছাড়াও, সংঘর্ষে সুমন শেখ, ফরহাদ নামের ২ যুবক মারা গেছেন বলেও নিশ্চিত করেছেন চিকিৎসকরা। তাছাড়া, জেলায় সংঘর্ষে আরও একজন নিহত হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
মুন্সিগঞ্জে যা হলো:
সকালে মুন্সিগঞ্জ শহরের সুপার মার্কেট এলাকায় জড়ো হন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। এ সময়, একইস্থানে অবস্থান নেয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। দেখা দেয় উত্তেজনা। দু’পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়। এ সময় গোলাগুলি ও ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনাও ঘটে।
একপর্যায়ে সংঘর্ষে দু’জন মারা যান। তাদের পরিচয় এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। পরে টিয়ারশেল ছুঁড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তাছাড়া, জেলায় সংঘর্ষে আরও একজন নিহত হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
পাবনায় গুলিতে দু’জনের মৃত্যু:
সহিংসতায় পাবনাতেও মারা গেছেন দু’জন। জেলা শহরের চাতিকমোড় এলাকায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীরা বিক্ষোভ করে। এ সময় বিরোধী পক্ষের সাথে চলে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া। একপর্যায়ে গোলাগুলির ঘটনাও ঘটে। এতে আহত হয় অন্তত ৩০ জন। আর মারা যায় দু’জন। প্রাণহানির বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন পাবনা জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক এসএম রুমি।
বগুড়ায় চারজন নিহত:
বগুড়া সদর ও দুপচাঁচিয়া উপজেলায় গুলিবিদ্ধ হয়ে দু’জনের মৃত্যু হয়েছে। অভিযোগ, পুলিশের গুলিতেই তারা নিহত হয়েছেন। দুজনই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা এক দফা দাবির আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন।
জানা যায়, বেলা সাড়ে ১২টার দিকে বগুড়ার সদরের বড়গোলা এলাকায় বিক্ষোভ করেন আন্দোলনকারীরা। এ সময় পুলিশের সাথে তাদের সংঘর্ষ হয়। পুলিশের গুলিতে আহত হয় আনুমানিক ৩০ বছর বয়সী অজ্ঞাত এক যুবক। পরে তাকে উদ্ধার করে শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক।
দুপচাঁচিয়া উপজেলায় মনিরুল ইসলাম নামে এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। দুপুর ১২টার দিকে মারা যান। তার মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন জেলার সিভিল সার্জন শফিউল আজম। এছাড়া, শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আজ আহত হয়ে ১১ জন ভর্তি রয়েছে বলে জানা গেছে। এছাড়া বিভিন্ন হাসপাতালে ২০ থেকে ২৫ জন চিকিৎসা নিচ্ছেন।
তাছাড়া, জেলায় সংঘর্ষে আরও দুইজন নিহত হয়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে।
বরিশালে আওয়ামী লীগ নেতার মৃত্যু:
বরিশালে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষে টুটুল চৌধুরী (৬২) নামে এক আওয়ামী লীগ নেতা নিহত হয়েছেন। রোববার (৪ আগস্ট) দুপুরের দিকে নগরীর সরকারি সৈয়দ হাতেম আলী কলেজের পাশে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষে মারা যান তিনি।
জানা গেছে, নিহত টুটুল চৌধুরী বরিশাল সিটি করপোরেশনের ১২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ছিলেন।