ইউলিসিস


দৈনিক আলোড়ন
ইউলিসিস

তুই কি তা শুনতে চাস?’ স্টিফেন বলে।

‘অবশ্যই। কী সেটা?’ বাক মালিগান উত্তর করে। ‘আমারতে কিছুই মনে পড়ছে না।’

কথা বলার সময় মালিগান স্টিফেনের মুখের দিকে তাকায়। মৃদুমন্দ বাতাসে স্টিফেনের ভুরু কাঁপে, ফ্যাকাশে উশকোখুশকো চুল উড়তে থাকে, বাতাস তার চোখের তারায় ফুটে থাকা উদ্বেগের রুপালি বিন্দুগুলো উন্মুক্ত করে।

স্টিফেন, নিজের গলার আওয়াজে নিজে বিমর্ষ হয়ে বলে : ‘মা’র মৃত্যুর পর প্রথম যে-দিন তোর বাড়ি যাই সে-দিনের কথা তোর মনে আছে?’

বাক মালিগান ভ্রুকুটি করে সহসা বলে :

‘কী? কোথায়? নিজস্ব ধারণা আর সঙ্গমসুখ ছাড়া আমি কিছু মনে রাখি না। কেন? কী হয়েছিল ঈশ্বরকে দিব্যি রেখে বল তো।’

‘তুই চা তৈরি করছিলি,’ স্টিফেন বলে, ‘আমি সিঁড়ির ওপাশে গিয়েছিলাম গরম পানি আনতে। তোর মা আর কারা যেন বৈঠকখানা থেকে আসল। তোর মা জানতে চাইল তোর ঘরে কে?’

‘বটে?’ বাক মালিগান বলে। ‘কী বলেছিলাম আমি? মনে নাই।’

‘তুই বলেছিলি,’ স্টিফেন উত্তর করে, ‘ও, এখানে শুধু ডেডালাস, যার মার পাশবিক মৃত্যু হয়েছে।’

বাক মালিগানের সহসা আরক্ত গাল দেখে তাকে অপেক্ষাকৃত কম বয়সি আর গভীর মনোযোগী মনে হয়।

‘আমি কি তা বলেছি?’ মালিগান বলে। ‘ভালো কথা। তাতে হয়েছেটা কী?’

মালিগানকে উত্তেজিত মনে হয়, তবে সে তার বিচলিতভাব ঝেড়ে ফেলে।

‘মৃত্যুটা কী?’ মালিগান জিজ্ঞেস করে। ‘তোর মা’র মৃত্যু অথবা তোর কিংবা আমার নিজের মৃত্যু? তুই তো শুধু তোর মায়ের মরণ দেখেছিস। আর আমি তো প্রতিদিন হাসপাতালে মৃতের স্তূপ দেখি আর ওগুলোকে লাশকাটা ঘরে নিয়ে টুকরো টুকরো করি। এটা একটা পাশবিক কাজ, এর বেশি কিছু নয়; এর কোনো গুরুত্ব নেই। তোর মা মৃত্যুশয্যা থেকে তোকে নত হয়ে প্রার্থনা করতে বলল, আর তুই তা করলি না। কেন? তোর মধ্যে সেই অভিশপ্ত নাস্তিকতার ছাপ ছিল বলে? আসলে নাস্তিকতা তোর মধ্যে ঢুকেছে ভুল পথে। এর সব কিছুই আমার কাছে উপহাস আর পাশবিকতা। তোর মা’র মস্তিষ্কের উপরের অংশ অচল হয়ে গিয়েছিল। তাই তো সে ডাক্তারকে স্যার পিটার টিজল বলে ডেকেছিল আর ওভাবে তোশকের আলপনাগুলো ছিঁড়ছিল। জানটা বের হওয়া পর্যন্ত তো তুই তাকে তুষ্ট রাখতে পারতিস। তুই তোর মায়ের শেষ ইচ্ছে ছিঁড়ে ফেলেছিস, আর এখন আমার উপর রাগ দেখাচ্ছিস, কারণ আমি মর্গ থেকে ভাড়া করে আনা শোক-কারিনীর মতো হাউমাউ করে কাঁদিনি। কি আশ্চর্য! মানছি, আমি তা বলেছিলাম। কিন্তু আমি তোর মা’র স্মৃতিকে তো আহত করতে চাইনি।’

মালিগানের নিষ্ঠুর আক্রমণে স্টিফেনের হৃদয়ে ক্ষতের সৃষ্টি হয়। সে তা গোপন করে আর শুষ্ক কণ্ঠে বলে : ‘আমি আমার মায়ের অপমানের কথা ভাবছি না।’

‘তা হলে সেটা কী?’ বাক মালিগান প্রশ্ন করে।

‘আমি বলছি আমার অপমানের কথা,’ স্টিফেন বলে।

বাক মালিগান গোড়ালির উপর ভর করে ঘুরে দাঁড়ায়।

‘আহ্, তোর সঙ্গে পারা যাবে না!’ মালিগান ক্রুদ্ধ হয়ে বলে।

মালিগান দ্রুত পাঁচিলের চারপাশে একবার ঘুরে আসে। স্টিফেন তার জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে শান্ত সমুদ্রের উপর দিয়ে অন্তরীপ পর্যন্ত চোখ বুলায়। সাগর আর কূল দুটোই কুয়াশাচ্ছন্ন। তার চোখের পাতা কাঁপে আর দৃষ্টিকে ঢেকে দেয়। স্টিফেন দুই গালে জ্বরের মতো গরম অনুভব করে।

টাওয়ারের ভেতর থেকে এক উচ্চকণ্ঠ ভেসে আসে :

‘মালিগান, তুমি কি এখনো ছাদেই আছ?’

‘আমি আসছি,’ বাক মালিগান বলে।

মালিগান স্টিফেনের দিকে ফিরে বলে :

‘সমুদ্রটা দেখ। সে কি কারও অপমানকে পাত্তা দে? গোয়ার্তুমি ছাড়, কিন্চ; নিচে চল। আয়ারল্যান্ডের জবরদখলকারী এক স্যাক্সন শুকরের মাংস দিয়ে নাশতা করার জন্য অস্থির হয়ে আছে।’

মালিগান সিঁড়ির সামনে গিয়ে থামে, তার মাথা ছাদ বরাবর।

‘এ নিয়ে সারা দিন বিষণ্ন থাকার কোনো মানে নেই,’ মালিগান বলে। ‘আমি অতি তুচ্ছ জীব। বাদ দেয় তোর এই অহংকারী আত্মমগ্নতা।’

মালিগানের মাথা সিঁড়ির পথে অদৃশ্য হয়, কিন্তু তার চড়া গলায় ইয়েটস-এর লেখা সেই গানের আওয়াজ সিঁড়ির মাথা পর্যন্ত ভেসে আসে :

আর নয় একাকী আত্মমগ্নতা

প্রেমের তিক্ত রহস্যে;

রাস্তা দখল নিয়েছে এক আইরিশ বীর।

সকালের শান্ত আবহাওয়ায় গাছের ছায়া সমুদ্র্র অভিমুখে ভেসে যায়। সেখানে স্টিফেনের চোখ পড়ে। বালুচর, আর তারও পর সাদা হতে থাকা জলের মুকুর, তটে হাওয়া খেতে আসা মানুষের ত্বরিত পায়ের আঘাতে ছিটকে পড়া জল। ঘোলা সাগরের সাদা বুক। তরঙ্গে তরঙ্গে আলিঙ্গন। বীণার তারে হাতের টান; ওঙ্কার ঝঙ্কার। ঢেউ-সাদা কল্লোলে চকিত মলিন স্রোত।

একটা মেঘ সূর্যকে ধীরে ধীরে, সম্পূর্ণরূপে ঢেকে দেয় আর সমুদ্রের উপর ঘন সবুজ ছায়া ফেলে। নিচের সমুদ্র স্টিফেনের চোখে এক বিশাল তিক্ত জলাধার। স্টিফেন ভাবে, মালিগানের গাওয়া গান। লম্বা, কালো তারগুলো টেনে ধরে যা আমি ঘরের মধ্যে একাকী গেয়েছি। কারণ মা আমার গান শুনতে চেয়েছিল। মা’র দরজা খোলা ছিল। বিষ্ময় আর কৃপায় আহত নীরব আমি তার শয্যাপাশে যাই। হতভাগ্য বিছানাটায় শুয়ে মা কাঁদছিল। সেই সব শব্দ : প্রেমের তিক্ত রহস্য।

মা এখন কোথায়?

তার গোপন, প্রিয় জিনিসপত্র : পুরোনো পালক-পাখা, সুতায় গ্রথিত নৃত্যগীতের সুগন্ধি-মাখানো পুস্তিকা, ড্রয়ারে তালাবদ্ধ পাথরের হার, প্রার্থনার তছবি। রৌদ্র্রঝলমল জানালায় ঝোলানো ছোটবেলার পাখির খাঁচা। আইরিশ লেখক এডউইন হ্যামিলটনের লেখা কৌতুকনাট্য ‘ভয়ানক টার্ক’ এর অভিনয়কালে ইংরেজ ভাঁড় রয়েসের গান শুনে মা সতীর্থদের সঙ্গে হেসেছে :

আমি অধম

কিন্তু সক্ষম

উপভোগ করতে অদৃশ্যম।

স্টিফেন মায়ের ছায়ামূর্তির আনন্দের কথা ভাবে, যা বহু দূর চলে গেছে। তবুও তা স্টিফেনের স্মৃতিতে অমলিন।

ঘুরে ঘুরে আর দুঃখ করা নয়, স্টিফেন ভাবে।

মা তার খেলনাগুলো নিয়ে প্রকৃতির স্মৃতিতে গুটিয়ে গেছে। মায়ের স্মৃতিগুলো স্টিফেনের চিন্তাক্লিষ্ট মস্তিষ্কে আঘাত হানে। প্রতি সকালে গির্জায় গিয়ে প্রার্থনা শেষ না হওয়া পর্যন্ত সেখানে মায়ের অবস্থান। শরতের কোনো বিকালে মায়ের চুলায়-চিনি-মেশানো আপেলের সিদ্ধ হতে থাকা রোস্ট। বাচ্চাদের ত্বকে আর জামায় লেগে থাকা পোকা মারতে গিয়ে তার সুডৌল হাতের নখে লেগে যাওয়া লাল দাগ।

স্বপ্নের মতো মা স্টিফেনের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। কাফনের ভেতর মায়ের ক্ষয়প্রাপ্ত দেহে মোম আর পুরোনো কাঠের গন্ধ, ভেজা ছাইয়ের ক্ষীণ গন্ধ; মায়ের ঝুঁকে পড়া শরীরের নিশ্বাস, নীরব, গোপন কথা।

মৃত্যুর ভেতর থেকে মায়ের স্বচ্ছ চোখের স্থির দৃষ্টির সামনে স্টিফেনের আত্মা দুমড়েমুছড়ে কেঁপে ওঠে। ভয় শুধু স্টিফেনকে আঘাত করে। ভূত তাড়ানোর বাতি জ্বলে চলেছে, মায়ের মর্মবেদনা লাঘব করার জন্য। মায়ের যন্ত্রণাবিদ্ধ মুখে ভৌতিক আলো। স্টিফেন দেখে আর সবাই হাঁটু গেড়ে বসে প্রার্থনা করে; মায়ের কর্কশ সশব্দ নিশ্বাস মুমূর্ষু যন্ত্রণায় ঘড়ঘড় করে ওঠে। মায়ের চোখ স্টিফেনের উপর, যেন তাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিবে। স্টিফেনের কানে প্রার্থনাকারীদের আওয়াজ প্রবেশ করে : পাপস্বীকারকারীর দল, শাপলার মতো উজ্জ্বল, তোমাকে ঘিরে রাখুক। উৎফুল্ল কুমারী গায়িকাদল, তোমাকে সঙ্গে নিক।

ঘাউল! মৃতের মাংস চোষা দানব!

না, মা! আমাকে আমার মতো বাঁচতে দেয়।