ভালোবাসো প্রতিদিন


দৈনিক আলোড়ন
ভালোবাসো প্রতিদিন

চলছে ভালোবাসার মাস। এ মাসে কথিত ভালোবাসার গভীরতা বেশি থাকলেও বছরজুড়ে ভালোবাসার ওপর রীতিমতো গবেষণা চলে। এই ভালোবাসা বিভিন্ন রকম হতে পারে। যেমন প্রেমিক-প্রেমিকার ভালোবাসা, স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসা, সন্তান-বাবা-মার ভালোবাসা ইত্যাদি।

প্রশ্ন উঠতে পারে, ভালোবাসায় আবার কী এমন গবেষণা? অবশ্যই গবেষণা হতে পারে, আর তার প্রধান কারণ হলো ভুল বোঝাবুঝি। ভুল বোঝাবুঝিতে হারিয়ে যায় একে অন্যের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা আর শুরু হয় সমস্যা। তখন গবেষণার মাধ্যমে উভয় পক্ষের গঠনমূলক আলোচনা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে সমস্যার সমাধান দিতে। আর তখনই সঠিক তথ্য এবং সিদ্ধান্ত পাওয়া সম্ভব হয়।

একদল মনোবিজ্ঞানী মনে করছেন বেশিরভাগ যুবক তাদের তুলনায় বেশি বয়স্ক যুবতীদের পছন্দ করছেন। প্রেম কিংবা বিয়ে-শাদির ক্ষেত্রেও ইউরোপে এখন বেশিরভাগ পুরুষই তুলনামূলকভাবে বয়সে বড় নারীকে জীবনসঙ্গিনী হিসেবে পছন্দ করছেন। তাদের বেশিরভাগের যুক্তি, বয়সে বড় প্রেমিকা বা স্ত্রী মানেই একজন চমৎকার ও অভিজ্ঞ গাইড যে আপনাকে নানাভাবে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করতে পারে। যদি কেউ এমন ধরনের প্রতিবেদন প্রকাশ করে সেটা সম্পূর্ণ সত্যি নয়। কারণ এমনটি অতীতেও ছিল এখনও রয়েছে।

প্রেমের ক্ষেত্রে বয়স বিশেষ গুরুত্ব পায় না বলেই দেখা যায়। তাই তো এখন যে কোনো বয়সের মানুষ যেকোনো বয়সের মানুষের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক তৈরি করেন। তবে হ্যাঁ, বহু বছর আগে আমাদের সমাজের নিয়ম ছিল যে, সম্পর্কের ক্ষেত্রে নারীকে সবসময় পুরুষ অপেক্ষা কমবয়সী হতে হবে। কিন্তু সমাজ বদলেছে। আমাদের মানসিকতাও বদলেছে। তাই এখন অনেক সময়েই দেখা যায় কোনো সম্পর্কে নারীরা পুরুষের থেকে বেশি বয়সের হয়।

প্রেম কিংবা ভালোবাসা যাই হোক না কেন, মানুষের জীবনে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। পৃথিবীতে এমন কোনো মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না, যিনি জীবনে একবারের জন্য হলেও কারও প্রেমে পড়েননি। প্রেম বা ভালোবাসা হচ্ছে এমন এক জিনিস, যা কোনো ধরনের সংজ্ঞা দ্বারা বিধিবদ্ধ করা সম্ভব নয়। কখন কাকে ভালো লেগে যায়, সে সম্পর্কে আগে থেকে কেউই সঠিকভাবে অনুমান করতে পারেন না।

প্রেমিক বা প্রেমিকার অনুভূতির সামনে বয়স, ধর্ম কিংবা পারিবারিক কোনো বিষয় প্রতিবন্ধক হয়ে উঠতে পারে না। তবে আমাদের সমাজব্যবস্থা রক্ষণশীল হওয়ায় প্রেম কিংবা বিয়ের জন্য উপযুক্ত পাত্রী নির্বাচনের ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি বিষয়কে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

সচরাচর ভিন্ন ধর্মের দুজন মানুষের মধ্যকার প্রেমের পরিণতি আমাদের উপমহাদেশে খুব কমক্ষেত্রেই গ্রহণযোগ্যতা পায়। অন্যদিকে সাধারণত অসম প্রেমকাহিনী, বিশেষ করে প্রেমিকের তুলনায় প্রেমিকা যদি বয়সে বড় হন, তাহলে সে ধরনের প্রেম কাহিনীও আমাদের সমাজে আলোচিত বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের সমাজব্যবস্থায় কখনো কোনো মা-বাবা মেনে নিতে পারেন না যে তাদের ছেলে এমন কোনো মেয়ের সঙ্গে প্রেম কিংবা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হোক, যে মেয়ে তাদের ছেলের তুলনায় বয়সে বড় বা ধর্মে ভিন্ন।

তবে ইউরোপের প্রেম আগের মতোই রয়েছে। আমি প্রায় চল্লিশ বছর এখানে। সমবয়সী এবং সম-মনের মানুষের মধ্যেই প্রেমের বিনিময় হয় এখানে। ব্যতিক্রম রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে যারা লাজুক, লেখাপড়া ছাড়া অন্য কিছু বোঝে না, সামাজিকতা করতে শেখেনি, তাদের পক্ষে পাত্রী জোগাড় করা কঠিন। সেক্ষেত্রে তারা শেষে বয়স্ক বা গরীব দেশের পাত্রী বিয়ে করে সংসার করছে। অতীতের তুলনায় পার্থক্য এতটুকুই সেটা হলো বিদেশি পাত্রী বেশি দেখা যাচ্ছে ইদানীং এবং এরা বেশির ভাগই দরিদ্র দেশের নাগরিক।

আরেকটি দিক খেয়াল করা যেতে পারে, সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন গণতন্ত্রের ছোঁয়া পায়নি তখন সেখানকার মেয়েরা বাইরের ছেলেদের বিয়ে করেছে দেশ ছাড়ার উদ্দেশ্যে, যা এখন ইতিহাস। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর যে সমস্ত শিক্ষার্থী তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নে লেখাপড়া করেছে তাদের বেশির ভাগই বিয়ে করেছে সেখানে। তার অর্থ এই নয় যে সোভিয়েত মেয়েরা বিদেশিদের প্রতি প্রেমে গদগদ হয়ে গিয়েছিল। বরং কারণটা হলো এই, সমাজতন্ত্রের কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যে হাঁপিয়ে ওঠা নারীরা বিদেশিদের বিয়ে করে নিজেদের দেশ ছেড়ে ইউরোপের অন্যান্য দেশে যেতে পারবে এবং মুক্ত পরিবেশের জীবনকে উপভোগ করতে পারবে।

একটি গল্প মনে পড়ে গেলো, বহু বছর আগের কথা। সুইডেনে তখন সামার। পার্কে বসে আছে একটি সুন্দরী রমণী। পাশ দিয়ে হেটে যাচ্ছিল পদার্থ বিজ্ঞানের একজন ছাত্র। মেয়েটিকে দেখামাত্রই ছাত্রটি প্রেমে পড়ে। কিন্তু কিছুতেই সাহস পাচ্ছে না বলতে বা মেয়েটির পাশে বসতে। এক পা এগিয়ে আবার দু পা পিছিয়ে আসে। আর সেইসঙ্গে পদার্থ বিজ্ঞানের নানা সূত্র প্রয়োগ করছে, কীভাবে কী করবে, কখন, কোথায় বসবে ইত্যাদি।

সূর্য প্রায় অস্ত যাবার পথে, বিজ্ঞানী সাহেব গবেষণা করে চলেছেন। হঠাৎ একটি সাধারণ ছেলে তার কাজ শেষে একই পথ দিয়ে যাচ্ছিল। মেয়েটি তার নজরে পড়ে যায়। কোনো কথা নেই। চুপটি করে মেয়েটির পাশে গিয়ে বসে। এরপর কিছু কথা, কিছুক্ষণ দেখা, পরে মেয়েটার হাত ধরে চলে গেলো বৈজ্ঞানিক সাহেবের নাকের ডগার উপর দিয়ে। বেচারা বিজ্ঞানী তখন ফ্যাল ফ্যাল করে তাদের চলে যাওয়া দেখতে থাকে।

প্রেমে মনের মিলন হতে বেশি হিসাব-নিকাশ করলে সময় পার হতে থাকে তখন সময়মতো পাত্রী পাওয়া যায় না। এটি যেকোনো দেশেই হতে পারে। আমার চেনা-জানা এক বাংলাদেশি সুদর্শন যুবক। কেবল পাত্রীর সন্ধান করে বেড়ায়। ব্যর্থ হয়ে সব আশা ছেড়ে দেয়। অবশেষে তার বড় ভাই হঠাৎ মারা গেলে ভাইয়ের বিধবা স্ত্রীকে সন্তানাদিসহ ঘরে তোলে। এভাবে ইউরোপের অনেকের ভাগ্যে মাঝেমধ্যে বয়স্ক মেয়ে জোটে। তার অর্থ এই নয়, বয়সে বড় প্রেমিকার দিকে ঝুঁকছে ইউরোপের পুরুষ।

ইউরোপের সমাজব্যবস্থা বিশ্বের অন্যান্য দেশের চেয়ে অনেক উদার, যদিও আমাদের দেশে পারিবারিক কাঠামো এখন বলতে গেলে অনেকটা দুর্বল। এ কারণে আমাদের দেশে বিবাহবিচ্ছেদের হার বেড়ে গিয়েছে। যার প্রভাব সরাসরি পড়ছে পরিবারের সন্তানদের ওপর। অন্যদিকে ইউরোপের অনেক দেশে বিবাহের ওপর মানুষের আকর্ষণ অনেকটা কমে এসেছে, তবুও ছেলেরা বর্তমান সময়ে প্রেমিকা বা বিয়ের পাত্রী নির্বাচনের ক্ষেত্রে শুধু বয়স নয় নানা বিষয়ের ওপর প্রাধান্য দেয়।

এখানে গাইড দেবার কিছু নেই, মিউচুয়াল রেসপেক্ট বড় বিষয়। এছাড়া যেকোনো বিষয়ে দুজন পারস্পরিক মতামতের ভিত্তিতে একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারে। মাঝে মধ্যে উদ্ভট খবর ছড়িয়ে একটি সমাজের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলার আগে আমি মনে করি সত্যতার যাচাই-বাছাই হওয়া দরকার। বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে বসে গবেষণা করা আর বাস্তবে তার প্রয়োগ অনেক সময় এক নয়, প্রেমের ক্ষেত্রে অগত্যা।

আমি সুইডেনে আজ থেকে ২৯ বছর আগে বিয়ে করেছি, আমার স্ত্রী আমার চেয়ে বয়সে কয়েক বছরের ছোট। বন্ধুবান্ধবদের ক্ষেত্রে একই অবস্থা। তবে কিছু কিছু বন্ধু দেশের বাইরে বিয়ে করেছে কিন্তু তাদের বয়স কত তা বলতে পারবো না। অবশ্য এ ধরণের বন্ধুরা বিয়ে করেছে বেশ দেরিতে। বর্তমানে বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মদের দেখে মনে হচ্ছে তারা এ বিষয়ে ইউরোপিয়ানদের মতই জীবন লিড করছে। বিয়ের আগে চেনা-জানা বা পছন্দের মানুষটিকে সঙ্গী/সঙ্গিনী হিসেবে বেছে নিতে শুরু করেছে। জানি না এটা অতীতের তুলনায় ভালো না খারাপ, যাই হোক না কেন ‘চয়েস ইজ ইওরস’।

বয়সে বড়-ছোট বলে কথা নয়, কথা হচ্ছে যেকোনো পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। অ্যাগ্রি টু ডিজঅ্যাগ্রি কনসেপ্টে বিশ্বাস থাকতে হবে। যেকোনো সন্ধিকালীন মুহূর্তে ভুল বোঝাবুঝির সম্ভাবনা কমাতে হবে, যাতে করে সম্পর্কের গভীরতাও হয় অনেক দৃঢ়। তবে হ্যাঁ আমরা সুইডেনের বর্তমান রাজা, লন্ডনের উইলিয়াম এবং ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁসহ অনেকের কথা জানি, যারা তাদের তুলনায় বয়সে বড় কোনো নারীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন।-

পাশ্চাত্য দেশগুলোতে এ বিষয়গুলো অনেকটা স্বাভাবিক তবে দরিদ্র দেশে এর উল্টোটাই হয়ে থাকে যার মধ্যে ভালোবাসার চেয়ে অর্থনৈতিক সংকট বেশি কাজ করে। যেমন বাংলাদেশের সাবেক রেলমন্ত্রী বিয়ে করেন অল্প বয়সের একটি মেয়েকে। সেক্ষেত্রে যদি কেউ বলে উপমহাদেশের রক্ষণশীল সমাজব্যবস্থায় এখনো এই বিষয়টি তেমন একটা গ্রহণযোগ্যতা পায়নি সেটা সঠিক নয়। মানুষ অতীতে হয়তো ছিল কিছুটা ইমোশনাল, পরে প্রাক্টিকাল আর এখন হয়েছে প্রফেশনাল। তবে ভালোবাসার ক্ষেত্রে প্রেমিকেরা ঠিক সেই আগের মতোই ভাবে।

আজকের এই দিনে ঠিক কবিগুরুর মতো ভালোবেসে মারিয়ার হাত ধরে নিভৃতে যতনে হাঁটতে হাঁটতে বাল্টিক সাগরের পাড়ে এসেছি। আজ ১৪ ফেব্রুয়ারি বিকেলে বাড়িতে বড় আকারে পার্টি হবে। সাগর পাড় দিয়ে হাঁটাহাঁটি করা আমার বহু দিনের অভ্যাস। তাছাড়া সাগরের ঢেউ যখন শীতের দেশে বরফের ওপর আঘাত করে ফিরে যায় আবার ফিরে আসে, দেখে মনে হয় পানি এসেছিল বরফের সঙ্গে থাকতে ক্ষণিকের তরে।

মারিয়া আমার সহধর্মিনী আর আমি বরফের ওপর দিয়ে হাঁটছি সঙ্গে উপভোগ করছি বাল্টিক সাগরকে। দেখছি পাহাড়ের ওপর গড়ে উঠা বিশাল বিলাসবহুল বসতবাড়ি। দেখতে দেখতে হাজির হলো এক ঝাঁক সামুদ্রিক পাখি, সুইডিশ ভাষায় এ পাখির নাম ‘ফিস্ক মোছ’(Sea-mew, eng.)। সামুদ্রিক এ পাখির জীবনধারা, আচরণে আকর্ষণীয় অভিসারী বিবর্তন প্রদর্শন করে তাদের ভালোবাসার মাঝে। সামুদ্রিক এ পাখি এবং মানবজাতির মধ্যে অনেক ঐতিহাসিক মিল রয়েছে।

যেমন তারা শিকারিদের খাদ্য সরবরাহ করে, জেলেদের মাছ ধরার ভাণ্ডারে যাবার পথ দেখায়, এবং নাবিকদের স্থলভূমিতে পৌঁছানোর পথও দেখায়। ১৪ ফেব্রুয়ারি পৃথিবীজুড়ে ভ্যালেন্টাইনডে বা ভালোবসার দিন। সামুদ্রিক এ পাখি আমাকে তার ওপর একটি শিক্ষা দিয়েছে। বরফের ওপর পড়ে রয়েছে একটি গোলাপ ফুল ডালসহ, ওমা একটি ফিস্ক মোছ দিব্যি ফুলটিকে মুখে নিয়ে কী সুন্দর করে চলে গেল ফুলটি উপহার দিতে তার সঙ্গিনীকে। দৃশ্যটি দেখে আমি তো অবাক এবং মনোমুগ্ধ হয়ে গেলাম। পাখির জগতে ভালোবাসা আছে নিশ্চিত কিন্তু সাগরের তীরে গোলাপ ফুল উপহার দেয়া সঙ্গিনীকে তাও ১৪ ফেব্রুয়ারি, এ দৃশ্যটি ছিল বিরল।

ভালোবাসার মধ্যে রয়েছে শুধু ভালোবাসা, সে ভালোবাসা হতে পারে সবার জন্য। তাই সবাইকে প্রাণঢালা ভালোবাসা এই মধুময় ভ্যালেন্টাইন দিনে।