অর্থ পাচার বাড়ছে আশঙ্কাজনকভাবে


Apurbo Ahmed Jewel
অর্থ পাচার বাড়ছে আশঙ্কাজনকভাবে

ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বিপুল অঙ্কের অর্থ বিদেশে পাচার করা হয়েছে। যেহেতু সরাসরি টাকা পাচার করা যায় না, ডলার প্রয়োজন হয়; তাই আন্ডার ও ওভার ইনভয়েসিংয়ের পথ বেছে নেওয়া হয়। এর মাধ্যমে বড় অঙ্কের ডলার বিদেশে চলে যায়। পাশাপাশি হুন্ডির মাধ্যমেও ব্যাপক বৈদেশিক মুদ্রা পাচারের ঘটনা ঘটে। বিশেষ করে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে গত দুই বছরে আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে অর্থ পাচার। আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) বার্ষিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য।

প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে ব্যাংক ঋণে জালিয়াতির ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এ সময়ে বিএফআইইউ-এর অনুসন্ধানে ১ হাজার ১১২টি সন্দেহজনক লেনদেন ধরা পড়ে। ২০১৮ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের জুন অর্থাৎ ২০২০-২০২১ অর্থবছরের শেষ পর্যন্ত সন্দেহজনক লেনদেনের ঘটনা সহনীয় পর্যায়ে ছিল বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। তবে ২০২১ সালের জুলাই থেকে ২০২৩ সালের জুন সময়ে মাত্রাতিরিক্ত হারে বেড়ে যায় জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ নেওয়ার ঘটনা। এ দুই বছরে ৮৬১টি সন্দেহজনক ঋণ বিতরণ ও সমন্বয়ের ঘটনা ঘটে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বিদেশে পাচার করা হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। আর পাচারের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে ব্যবসায়িক চ্যানেল। বিএফআইইউ-এর নিরীক্ষায় উঠে এসেছে, অর্থ পাচারের মোট ঘটনার ৮০ শতাংশ বাণিজ্যিক চ্যানেল (ট্রেড বেইজড) ব্যবহার করা হয়েছে। ব্যাংক মালিকদের সহায়তায় এসব ঘটনা ঘটেছে বলে বিএফআইইউ-এর প্রধান কর্মকর্তা জানিয়েছেন। তারা ব্যাংক ঋণের শ্রেণীকরণের ক্ষেত্রেও জালজালিয়াতির আশ্রয় নিচ্ছে। এমন প্রবণতার কারণে অর্থ পাচার বন্ধ করা যাচ্ছে না।

প্রতিবেদনে ব্যাংক ঋণে ৬ ধরনের জালিয়াতি শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে বহু ঋণের অর্থ নির্ধারিত সময়ের আগে পরিশোধের ঘটনাকে সন্দেহজনক হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কারণ, এসব ঋণের আড়ালে কালোটাকা লেনদেন হয়েছে কি না, তা ক্ষতিয়ে দেখা হচ্ছে। এছাড়া ভুয়া নথি ও ভুয়া জামানতের মাধ্যমে ঋণ অনুমোদন ও বিতরণের তথ্য উঠে এসেছে। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির কারণে ব্যাংক খাতে তীব্র তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে। এ ধরনের খেলাপিরা হঠাৎ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে উধাও হয়ে যাচ্ছে, এরপর দেশান্তরী হচ্ছে বলে বিএফআইইউ-এর প্রতিবেদনে উঠে আসে।

অন্যদিকে শর্ত ভঙ্গ করে বেনামি ঋণের বিপরীতে বিপুল অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হয়। ওই অর্থ ভিন্ন খাতে ব্যবহার বা পাচার করা হয়েছে। এর বাইরে অর্থ পাচারের বিভিন্ন ধরনের কলাকৌশল শনাক্ত করেছে আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থাটি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ‘এসব ঘটনা তুলে আনার জন্য বিএফআইইউকে ধন্যবাদ। তবে এখন সরকারকে কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হবে কীভাবে পাচারের টাকা উদ্ধার করা যায়। এ রিপোর্টের ভিত্তিতে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া না হলে আরও দ্বিগুণ উৎসাহে পাচার কার্যক্রম চালিয়ে যাবে জালিয়াতচক্র।’

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, আর্থিক খাতে সন্দেহজনক লেনদেন রিপোর্টিং বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সন্দেহজনক লেনদেন রিপোর্টিং হয়েছে ১৪ হাজার ১০৬টি। আগের অর্থবছর এ ধরনের রিপোর্ট হয়েছিল ৮ হাজার ৫৭১টি। ২০২০-২১ অর্থবছরে এসটিআর (সন্দেহজনক লেনদেন) হয় ৫ হাজার ২৮০টি। এছাড়া নগদ লেনদেন রিপোর্টিংও (সিটিআর) অনেক বেড়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সিটিআর হয়েছে ২২ হাজার ৮৫৯টি। আগের অর্থবছর যা ছিল ২১ হাজার ১১৩টি।

বিএফআইইউ-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, পুরো অর্থবছরে সর্বোচ্চ ১২ হাজার ৮০৯টি সন্দেহজনক লেনদেনের রিপোর্ট জমা দিয়েছে ব্যাংকগুলো। এর আগের অর্থবছরে ৭ হাজার ৯৯৯টি রিপোর্ট জমা দিয়েছিল ব্যাংকগুলো। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো রিপোর্ট জমা দেয় ১২১টি। আর এক্সচেঞ্জ হাউজগুলো ৯০০ রিপোর্ট জমা দিয়েছে।

মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংকে এক সংবাদ সম্মেলনে এ প্রতিবেদনের বিস্তারিত তুলে ধরা হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন বিএফআইইউ-এর প্রধান মাসুদ বিশ্বাস। এছাড়া বিএফআইইউ-এর নির্বাহী পরিচালক রফিকুল ইসলাম, পরিচালক মো. আরিফুজ্জামান, ইমতিয়াজ আহমেদ মাসুম, বৈদেশিক মুদ্রা ও নীতি বিভাগের পরিচালক ও সহকারী মুখপাত্র সারোয়ার হোসেন, সাঈদা খানম, অতিরিক্ত পরিচালক কামাল হোসাইন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

এ সময় সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন বিএফআইইউ প্রধান। তিনি বলেন, গত বছর দেশে বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে ১ হাজার ৭১টি তথ্য বিনিময় হয়েছে। এর মধ্যে সিআইডিসহ পুলিশের বিভিন্ন সংস্থা নিয়েছে ৬৮০টি। বাকি তথ্য নিয়েছে দুদক, এনবিআর, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন সরকারি সংস্থা।

মাসুদ বিশ্বাস আরও বলেন, মানি লন্ডারিংয়ের ৮০ শতাংশ হয় ব্যাংকের মাধ্যমে। ব্যাংক যদি এটি বন্ধে সহযোগিতা না করে, তাহলে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। কারণ, একবার মানি লন্ডারিং হয়ে গেলে তা ফেরত আনা যায় না। তিনি জানান, পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনা ও সহযোগিতার জন্য ১০ দেশের সঙ্গে এমওইউ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এটি বর্তমানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রক্রিয়াধীন আছে। এ কার্যক্রম শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখবে কি না, তা শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির ওপর নির্ভরশীল।

এক প্রশ্নের উত্তরে বিএফআইইউ-এর প্রধান বলেন, বিএফআইইউ-এর তথ্যের ভিত্তিতে অর্থ পাচারের মামলা হয়েছে ৫৯টি। এর মধ্যে দুদক মামলা করেছে ৪৭টি, সিআইডি ১০টি এবং এনবিআর-এর বিশেষ সেল ২টি। এগুলো এখনো নিষ্পত্তি হয়নি।