করছাড় নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতারণায় আদানি!


দৈনিক আলোড়ন
করছাড় নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতারণায় আদানি!

ইসমাইল আলী: বাংলাদেশে বিদ্যুৎ বিক্রির জন্য ভারতের ঝাড়খণ্ডের গড্ডায় এক হাজার ৬০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করেছে আদানি। ২০১৯ সালে ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রের জমিকে বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চল (এসইজেড) হিসেবে ঘোষণা করে ভারত সরকার। এতে সব ধরনের শুল্ক-কর ছাড় পেয়ে যায় আদানি পাওয়ার।

চুক্তি অনুযায়ী, বাংলাদেশকে বিষয়টি ৩০ দিনের মধ্যে জানানোর কথা। কারণ শুল্ক-কর ছাড়ের কারণে ক্যাপাসিটি চার্জ ও কয়লা আমদানি ব্যয় কমে যাবে। তবে এ বিষয়টি বাংলাদেশকে জানানো হয়নি। কর ছাড়ের বিষয়টি গোপন রেখে বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতারণা করেছে আদানি। সংশ্লিষ্ট সূত্রে খোঁজ নিয়ে বিষয়টি জানা গেছে।

আদানির সঙ্গে সম্পাদিত বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি (পিপিএ) ঘেঁটে দেখা যায়, চুক্তির ১৩.২-এর (সি) ধারায় ক্যাপাসিটি চার্জের কথা বলা হয়েছে। ক্যাপাসিটি চার্জের হার লেখা হয়েছে পিপিএ’র শেষে শিডিউল-৬-এর টেবিল-এ তে। পিপিএ’র ১৩.১-এর (ডি) ধারায় শর্ত দেয়া হয়েছে, ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হবে কতগুলো অ্যাজাম্পশনের (শর্ত) ভিত্তিতে, যার একটি কর ও শুল্ক সংক্রান্ত। আর কর ও শুল্ক ভারতের করহার নীতির ওপর নির্ভরশীল থাকবে।

অ্যাজাম্পশনগুলো পিপিএ’র শেষে শিডিউল ৬ এর টেবিল ‘ডি’-তে দেয়া আছে। আর চুক্তির ১৩.১-এর (ই) ধারায় বলা হয়েছে, আদানি পাওয়ার অ্যাজাম্পশনগুলো (ট্যাক্স ও ভ্যাটের হার) কোনো পরিবর্তন হলে পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (পিডিবি) জানাবে। যদিও তা করেনি আদানি।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আদানির গড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জমিকে এসইজেড ঘোষণার জন্য ভারতে এ-সংক্রান্ত নীতিমালা পরিবর্তন করা হয়। সাধারণত ভারতে একক কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠানের জন্য কোনো এলাকাকে এসইজেড ঘোষণা দেয়ার নীতিমালা ছিল না। তবে ২০১৯ সালে ভারতের জাতীয় নির্বাচনের আগে মোদি সরকার এ নীতিমালা পরিবর্তন করে। এর আওতায় একক প্রতিষ্ঠান হিসেবে আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের এলাকাকে এসইজেড ঘোষণা দেয়া হয়। এতে আদানি পাওয়ার শূন্য শুল্ক এলাকার সুবিধা পেয়ে যায়।

ভারতীয় গণমাধ্যমের তথ্যমতে, এসইজেড ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে আদানি পাওয়ার সব ধরনের যন্ত্রপাতি আমদানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা পায়। বিদ্যুৎকেন্দ্রটির জন্য আদানি মোট আটটি দেশ থেকে যন্ত্রপাতি আমদানি করেছে, যার মধ্যে রয়েছে চীন, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, জার্মানি, সুইডেন, যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি ও গ্রিস। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিদ্যুৎকেন্দ্রটির ৯৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ যন্ত্রপাতি চীন থেকে আমদানি করে আদানি।

এদিকে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির কয়লা আমদানিতে শুল্ক ও সব ধরনের কর ছাড় পেয়েছে আদানি। এছাড়া কোম্পানিটিকে কোনো ধরনের গুডস অ্যান্ড সার্ভিস ট্যাক্স (জিএসটি), সারচার্জ বা অন্য কোনো শুল্ক-কর দিতে হবে না। সূত্রমতে, বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পূর্ণ সক্ষমতার চললে বছরে লাগবে সাত থেকে ৯ মিলিয়ন মেট্রিক টন কয়লা। ফলে শুধু কয়লা আমদানিতেই আদানি শুল্ক-কর ছাড় পাচ্ছে ২০০ মিলিয়ন ডলার।

অন্যদিকে ভারতের রাজ্য সরকার কার্বন নিঃসরণের জন্য প্রতি টন কয়লার ওপর ৪০০ রুপি বা চার দশমিক ৮৮ ডলার কার্বন ট্যাক্স আরোপ করে। এ ট্যাক্সও ছাড় পেয়েছে আদানি। বছরপ্রতি আট মিলিয়ন মেট্রিক টন কয়লা ধরলে বছরে কোম্পানিটি ছাড় পাবে প্রায় ৩৯ দশমিক শূন্য দুই মিলিয়ন ডলার। আর ২৫ বছরে তারা ছাড় পাবে প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার।

ভারতের সংবাদ মাধ্যম জানাচ্ছে, এসইজেড ঘোষণার ফলে আদানির গড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্রটি প্রথম পাঁচ বছর শতভাগ শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে। পরবর্তী পাঁচ বছর তারা পাবে ৫০ শতাংশ শুল্ক ছাড়।

তথ্যমতে, বিদ্যুৎকেন্দ্রটির যন্ত্রপাতির জন্য আদানির সাড়ে ১২ শতাংশ কাস্টম শুল্ক ও আবগারি শুল্ক, নির্মাণ কাজের জন্য ১৫ শতাংশ সার্ভিস ট্যাক্স, ঝাড়খণ্ডের বাইরে থেকে পণ্যসামগ্রী কেনার ক্ষেত্রে দুই শতাংশ কেন্দ্রীয় বিক্রয় শুল্ক, ঠিকাদারের বিলের ৪০ শতাংশের ওপর ১৫ শতাংশ হারে কম্পোজিট ট্যাক্স, সাড়ে পাঁচ শতাংশ ভ্যাট, নির্মাণ শ্রমিকদের জন্য এক শতাংশ কল্যাণ ট্যাক্স, চার শতাংশ কর্মচুক্তি ট্যাক্স, ঝাড়খণ্ডের রাজ্য সরকারকে পানির ব্যবহার চার্জ ও আয়কর প্রদানের কথাও ছিল। তবে এসব শুল্ক ও কর মওকুফ পেয়ে গেছে আদানি।

তথ্যমতে, আদানির কেন্দ্রটির জন্য পিডিবিকে মাসে ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হবে ৩৯ দশমিক ৪৩ মিলিয়ন ডলার। বিদ্যুৎ না কিনলেও এ অর্থ দিতে হবে। এ হিসাবে আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রটির জন্য বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হবে ৪৭৩ দশমিক ১৬ মিলিয়ন ডলার। আর ২৫ বছরে এ চার্জ বাবদ ব্যয় হবে প্রায় ১১ দশমিক ৮৩ বিলিয়ন ডলার বা এক লাখ ২৬ হাজার ৫৮১ কোটি টাকা (১ ডলার = ১০৬.৯৫ টাকা)।

সূত্র জানায়, আদানির ক্যাপাসিটি চার্জের মধ্যে উল্লিখিত সব ধরনের শুল্ক ও কর ধরা আছে। তাই আদানি ভারতে কোনো ধরনের শুল্ক ও ছাড় পেলে তা ৩০ দিনের মধ্যে জানানোর শর্ত রয়েছে। তার ভিত্তিতে ক্যাপাসিটি চার্জ সমন্বয় করতে হবে। তবে বাংলাদেশকে বিষয়টি না জানিয়ে প্রতারণা করেছে আদানি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিদ্যুৎ খাতের নীতিগবেষণা সংস্থা পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রকে এসইজেড ঘোষণা করে সব ধরনের কর ছাড় দেয়া হয়েছে বিষয়টি জানা ছিল না। তবে সম্প্রতি ভারতের গণমাধ্যমে বিষয়টি এসেছে। তাই কর ছাড় নিয়ে আদানি আর ফাঁকি দিতে পারবে না। তাদের এরই মধ্যে চিঠি দেয়া হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, আদানির সঙ্গে আলোচনায় কর ছাড়ের বিষয়টি সামনে আনা হবে। আর কর ছাড়ের অনুপাতের ভিত্তিতে ক্যাপাসিটি চার্জ সমন্বয় করা হবে। প্রয়োজনে পিপিএ সংশোধন করা হবে।