৩১ হাজার কোটি টাকা লুট


Apurbo Ahmed Jewel
৩১ হাজার কোটি টাকা লুট

সরকারি অর্থের অনিয়মের অর্ধেকই হচ্ছে ব্যাংকিং খাত ঘিরে। বাংলাদেশ কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি)-এর বিগত চার বছরের অডিট রিপোর্টে উঠে এসেছে এমন তথ্য। ২০১৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সিএজি-এর রিপোর্টে মোট ৫৯ হাজার ৪৬৬ কোটি টাকার অনিয়ম চিহ্নিত করা হয়।

এর মধ্যে ৩১ হাজার কোটি টাকাই রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংকের। অর্থাৎ আর্থিক অনিয়মের ৫২ দশমিক ১৮ শতাংশ হচ্ছে ব্যাংকিং খাতে। পাশাপাশি বিগত ৯ বছরে ব্যাংকিং খাতে অনিয়মের পরিমাণ বেড়েছে ১৬ গুণ। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।

জানতে চাইলে সাবেক সিনিয়র অর্থ সচিব মাহবুব আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, সিএজির আর্থিক অনিয়ম রিপোর্টগুলো গুরুত্বসহকারে পর্যালোচনা করা দরকার। সংশ্লিষ্টদের কাছে এর জন্য জবাব চাওয়া যেতে পারে। পাশাপাশি পর্যালোচনা করে এই অনিয়মের জন্য দায়ী ব্যক্তি চিহ্নিত হলে তার বিরুদ্ধে প্রচলিত আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বলেন, ব্যাংকিং খাতে অনিয়ম বেড়েছে, এতে সন্দেহ নেই। দুঃখজনক হচ্ছে-খেলাপি ঋণ না দেখিয়ে তা মুছে ফেলার সক্রিয় প্রায়াস চলছে। এতে অনিয়মে খেলাপি ঋণ বাড়লেও সেটি লুকিয়ে ফেলা হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, ব্যাংকিং খাতের মোট ঋণের ৪০ শতাংশই হচ্ছে খেলাপি ঋণ। করোনা মহামারির আগে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৯৫ হাজার কোটি টাকা প্রকাশ করা হয়। প্রকৃতপক্ষে এটি আরও চার গুণ হবে। তবে ব্যাংকের টাকা মেরে দিয়ে ইচ্ছাকৃত খেলাপি ও বিদেশি অর্থ পাচার করা হয়েছে। এসব টাকা ফেরত আসবে না। আর এসব দুর্নীতি করা হয়েছে কতিপয় ব্যাংকার ও রাজনীতিবিদের সঙ্গে গোপন আঁতাত করে। এর ফলে গত ১০ বছরে ব্যাংকিং খাতের অবস্থা খারাপের দিকে গেছে।

এ প্রসঙ্গে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অব বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান দৈনিক আলোড়নকে  বলেন, আর্থিক অনিয়ম আগের বছরের তুলনায় বৃদ্ধির বিষয়টি উদ্বেগজনক। কেন এমন হলো, এটি দেখতে হবে। এর প্রথম কারণ হচ্ছে বিগত সময়ে আর্থিক অনিয়মের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। দায়ীদের বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। যে কারণে অনিয়মের পরিমাণ আগের তুলনায় বেড়েছে। তবে দায়ীদের বিচারের আওতায় আনা না হলে ভবিষ্যতে আর্থিক অনিয়মের পরিমাণ আরও বাড়বে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সিএজি ২০১৩ সালে যে রিপোর্ট তৈরি করেছে, সেখানে ব্যাংকিং খাতের আর্থিক অনিয়ম চিহ্নিত ৬৫২ কোটি টাকা। আর সর্বশেষ ২০২১ সালে যে রিপোর্ট তৈরি করেছে, সেখানে ১০ হাজার ৯৯৫ কোটি টাকা হচ্ছে ব্যাংকিং খাতের অনিয়ম। অর্থাৎ এই ৮ বছরে অনিয়মের হার বেড়েছে ১৬ দশমিক ৮৬ গুণ।

সূত্র আরও জানায়, ২০২১ সালের সিএজির রিপোর্টে (২০১৬-১৭ অর্থবছরের) মোট ২৪ হাজার ৫৫৪ কোটি টাকার আর্থিক অনিয়ম চিহ্নিত করা হয়। এর মধ্যে ব্যাংকিং খাতের অনিয়মের পরিমাণ ১০ হাজার ৯৯৫ কোটি টাকা। ২০১৯ সালের রিপোর্টে মোট অনিয়ম চিহ্নিত করা হয় ১১ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৫ হাজার ৫৩৯ কোটি টাকাই হচ্ছে ব্যাংকিং খাতে। একইভাবে ২০১৯ সালে সিএজির রিপোর্টে অনিয়ম উঠে আসে ১১ হাজার ৭১০ কোটি টাকা, যার মধ্যে ৫ হাজার ৬১৩ কোটি টাকা ব্যাংকিং খাতের।

একইভাবে দেখা গেছে-২০১৮ সালে যে রিপোর্ট করা হয়, সেখানে মোট আর্থিক অনিয়ম চিহ্নিত করা হয়েছিল ১১ হাজার ৫০২ কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্যাংকিং খাতের অনিয়ম হচ্ছে ৮ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা। এসব অনিয়মের মধ্যে ক্রিসেন্ট ও থারমেক্স গ্রুপ মিলে ১১ হাজার ২৩০ কোটি টাকা নিয়ে গেছে। এছাড়া বেসিক ব্যাংক থেকে চলে গেছে সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা, হলমার্ক কেলেঙ্কারিতে আত্মসাৎ হয়েছে ৩ হাজার ৫৪৭ কোটি টাকা।

ব্যাংকিং খাতের অনিয়ম প্রসঙ্গে সিএজির প্রতিবেদনে বলা হয়, ভুয়া জমি, সরকারি খাসজমি মর্টগেজ রেখে ও বন্ধকি জমি আইনজীবী কর্তৃক ভুয়া প্রমাণিত হওয়ার পরও গ্রাহককে ঋণ দেওয়া হয়। এছাড়া অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠান, ঋণ শোধের যোগ্যতাহীন প্রতিষ্ঠানকে ভুয়া বন্ধকি নিয়ে ঋণ ইস্যু করা হয়েছে। পাশাপাশি পর্যাপ্ত জামানত ছাড়া ঋণ বিতরণ, শ্রেণীকৃত দায় থাকার পরও ত্রুটিপূর্ণ সহায়ক জামানতের বিপরীতে এবং গ্রাহকের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও ঋণ দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে।

এসব ঋণ শেষ পর্যন্ত খেলাপিতে রূপ নেয়। সেখানে আরও বলা হয়, অস্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ঝুঁকিপূর্ণ খাতে ঋণ ইস্যু ও নিয়ন্ত্রণহীন এলাকার বাইরে তড়িঘড়ি করে ঋণ মঞ্জুর, শাখার আপত্তি উপেক্ষা ও বন্ধকি সম্পত্তি মূল্যায়ন ছাড়া ঋণ ইস্যু, মঞ্জুরি শর্ত অমান্য করে অনিয়মিতভাবে ওডি ঋণ দেওয়া হয়। এমন অসংখ্য অনিয়মের ঘটনা ঘটছে ব্যাংকিং খাতে। নিরীক্ষা প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, এসব অনিয়মের ক্ষেত্রে ব্যাংকের ঋণ বিতরণ নীতিমালা অনুসরণ করা হয়নি।

এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রজ্ঞাপন, আর্থিক বিধিবিধান ও সরকার কর্তৃক বিভিন্ন সময়ে আদেশ অমান্য করা হয়েছে। এসব সম্ভব হয়েছে ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা ও নিরীক্ষা কার্যক্রম দুর্বল থাকার কারণে।