মডেলিং থেকে অপরাধ জগতে আরাভ খান


দৈনিক আলোড়ন
মডেলিং থেকে অপরাধ জগতে আরাভ খান

মডেলিং থেকে অপরাধ জগতে আরাভ খান
অভাব-অনটনের সংসার ছিল আরাভ খান ওরফে রবিউল ইসলামের। ফেরিওয়ালা বাবার সামান্য উপার্জনের টাকা দিয়ে পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়া তার জন্য সহজ ছিল না। এজন্য বাগেরহাটের চিতলমারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে (এসএম মডেল স্কুল) পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে পাড়ি জমান ঢাকায়। যাতায়াত শুরু করেন এফডিসিতে। নানা কৌশলে মডেলিংয়ের জগতে প্রবেশ করেন। উঠতি বয়সি অনেক নারী মডেলের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন। সমাজের প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিদের টার্গেট করে ওই মডেলদের মাধ্যমে ব্ল্যাকমেইল করতে থাকেন। এভাবে প্রভাবশালী অনেক ব্যক্তির ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। একপর্যায়ে মডেলিং থেকে হাঁটতে শুরু করেন অপরাধজগতে। জড়িয়ে পড়েন খুনসহ নানা অপরাধে। এতে তার সঙ্গী ছিল দেশের আরও কয়েক বিতর্কিত মডেল ও কথিত প্রযোজক। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও চিতলমারীর স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে এসব তথ্য।
পুলিশ পরিদর্শক হত্যা মামলার চার্জশিটভুক্ত দুবাইয়ে পলাতক আসামি আরাভ খানকে দেশে ফিরিয়ে আনতে সব চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। শনিবার এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, এরই মধ্যে তাকে (আরাভ খান) ধরতে ইন্টারপোলের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। তাকে দেশে ফেরাতে সবরকম চেষ্টা চলছে। তবে আরাভ যেহেতু ভারতীয় পাসপোর্টধারী, সেক্ষেত্রে কোন আইনে ইন্টারপোলের মাধ্যমে তাকে বাংলাদেশে ফেরত আনা হবে-এই প্রশ্নের স্পষ্ট জবাব দেননি মন্ত্রী। এদিকে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ জানান, আরাভ নামে কারও সঙ্গে তার পরিচয় নেই।

বাগেরহাটের চিতলমারীতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আরাভের বাবা এখানেই ফেরি করে সিলভারের হাঁড়িপাতিল বিক্রি করতেন। এখানেই ১৯৮৮ সালে আরাভ খানের জন্ম হয়। এই এলাকায় তিনি রবিউল নামে পরিচিত ছিলেন। প্রথম শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত চিতলমারী কেজি স্কুলে (বর্তমানে শেখ হেলাল উদ্দিন একাডেমি) পড়াশেনা করেন তিনি। পরিবারসহ ভাড়া থাকতেন ইদ্রিস তালুকদারের বাড়িতে। ২০০৭ সালে এএসসি পরীক্ষা দেন। ২০১২ সাল পর্যন্ত তার পরিবার চিতলমারী ছিল। এর পরের খবর আর ওই এলাকার কেউ জানাতে পারেননি। তবে দীর্ঘদিন এলাকায় থাকার কারণে সেখানকার অনেকের সঙ্গেই তার এখনো যোগাযোগ রয়েছে। এরই সূত্র ধরে দুবাইয়ে অবস্থানকারী চিতলমারীর জনৈক শেখ তিতুমীরসহ অন্তত তিনজন দুবাইয়ে আরাভের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হিসাবে পরিচিত। এলাকায় জনৈক সুমন মুন্সী এখন তার ঘনিষ্ঠ বলে জানা গেছে।

আরাভের উত্থান নিয়ে তার ঘনিষ্ঠজন ও গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে, স্কুলে পড়া অবস্থায়ই তার ইচ্ছা ছিল ফিল্মে কাজ করার। এরপর পালিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। দীর্ঘ সময় এফডিসির আশপাশে ঘোরাফেরা করেন। এর মধ্যে হোটেল বয় হিসাবে কাজ করেন। জড়িয়ে পড়েন ছিনতাইয়ের মতো অপরাধে। পরবর্তীকালে ফিল্ম পরিচালক হিসাবে নাম ও নম্বর দিয়ে কিছু কার্ড ছাপান। সেগুলো হাতিরঝিলসহ আশপাশের এলাকায় বিতরণ করেন। দৈনিক ৩০০-৪০০ কার্ড বিতরণ করলে ১০-১৫ জন তাতে সাড়া দিতেন। তারা মডেলিং করার আশায় আরাভের দেওয়া স্থানে চলে যেতেন। এমন অনেকের কাছ থেকে আরাভ টাকাপয়সাও নিয়েছেন। পরে তিনি কিছু শর্ট ফিল্ম করেছিলেন। এগুলো করতে গিয়ে অনেক মেয়ের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। তাদের দিয়ে গুলশান-বনানীকেন্দ্রিক বড় চক্র গড়ে তোলেন। বদলে যেতে থাকে তার চলাফেরা ও চালচলন। শূন্য হাতে ঢাকায় আসা যুবক হয়ে ওঠেন প্রভাবশালী। এরপর তার বিরুদ্ধে অনেকের থেকে অন্যায়ভাবে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ আসতে থাকে।

তদন্তসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বুধবার দুবাইয়ে ‘আরাভ জুয়েলার্স’ উদ্বোধনে ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের মতো তারকার নাম আসায় চাপা পড়ে যায় আরও অনেকের কার্যক্রম। যারা আরাভের আমন্ত্রণে সেখানে গিয়েছেন। এমন অন্তত সাতজনের নাম রয়েছে গোয়েন্দাদের হাতে। যাদের কয়েকজন কেবল আরাভের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন এমন নয়, বরং দেশে তার উত্থান ও অপকর্মের সহযোগী। তাদের মধ্যে ইতঃপূর্বে র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার কথিত এক প্রযোজক এবং তার স্ত্রীও রয়েছেন। তার স্ত্রী ওই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করেছেন বলেও জানায় গোয়েন্দা সূত্র। ওই প্রযোজক নিজেকে সরকারের সাবেক এক মন্ত্রীর এপিএস বলে পরিচয় দিতেন। দেশে তিনি আরাভের ‘গুরু’ হিসাবে পরিচিত। এই চক্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ রয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের হাতে গ্রেফতার আরেক বিতর্কিত নারী মডেলের। যিনি এখন জামিনে রয়েছেন বলে জানা গেছে।

ফেসবুক পোস্টে ছলচাতুরী : আরাভ খান ফেসবুক অ্যাকাউন্টে ছবি পোস্ট করা নিয়েও নানা ছলচাতুরীর আশ্রয় নিয়েছেন। তার প্রোফাইলে ফটোশপের মাধ্যমে বিভিন্ন স্থানে এবং ব্যক্তির সঙ্গে ছবি এডিট করে পোস্ট করতে দেখা গেছে। ছবিগুলো যাচাই-বাছাইকারীরা বলছেন, ভালোভাবে দেখলেই বোঝা যায় এগুলো তার প্রকৃত ছবি নয়। এর মধ্যে লন্ডন ব্রিজ ও প্যারিসের আইফেল টাওয়ারের সামনের দুটি ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। একটি প্রাইভেট প্লেনে তার বসা ছবিও এডিট করা বলে জানা গেছে। এছাড়া এক স্থানে ছবি তুলে সেগুলো অন্য স্থানের নামে চালিয়ে দেওয়ার ঘটনাও খুঁজে পেয়েছেন নেটিজেনরা। এক্ষেত্রে ২০২০ সালের ২৭ ও ২৯ আগস্টের দুটি ছবি বেশ আলোচিত হয়। এগুলো নিউজিল্যান্ড ও যুক্তরাজ্যের ছবি বলা হলেও জানা যায়, সেগুলো ছিল ভারতের গোয়ার পাঞ্জিমের কোকো বিচ এবং আঞ্জুম বিচ।

যা বললেন সাবেক আইজিপি : দুবাইয়ে পলাতক খুনের আসামি আরাভ খানের উত্থানের বিষয়টি সামনে আসার পর থেকেই সাবেক এক ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তার কথা ঘুরেফিরে আসতে থাকে। এমন পরিস্থিতির মধ্যে পুলিশের সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ শনিবার বিকালে ফেসবুকে এ সংক্রান্ত একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন। যেখানে তিনি জানান, আরাভ ওরফে রবিউল ওরফে হৃদয় নামে কাউকে তিনি চেনেন না। এমনকি তার সঙ্গে প্রাথমিক পরিচয়ও নেই। তিনি লিখেছেন, “সম্মানিত দেশবাসী, আমি আপনাদের সবাইকে আশ্বস্ত ও সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিত করতে চাই যে ‘আরাভ ওরফে রবিউল ওরফে হৃদয়’ নামে আমি কাউকে চিনি না। আমার সাথে তার এমনকি প্রাথমিক পরিচয়ও নাই। আমি আমার ল এনফোর্সমেন্ট ক্যারিয়ারের পুরোটা সময় খুনি, সন্ত্রাসী, ড্রাগ ব্যবসায়ী, চোরাকারবারি, ভেজালকারী ও অপরাধীদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি, কখনোই সখ্য নয়।’

প্রসঙ্গত, পরিদর্শক হত্যা মামলার চার্জশিটভুক্ত ৮নং আসামি রবিউল ইসলাম ওরফে আরাভ। ২০১৮ সালের ৭ জুলাই রাজধানীর বনানীর একটি ফ্ল্যাটে খুন হন পুলিশ পরিদর্শক মামুন। এই হত্যাকাণ্ডের পর রবিউল ভারতে পালিয়ে যান। ২০২০ সালে রবিউল ভারতের পাসপোর্ট সংগ্রহ করেন। তার ভারতীয় পাসপোর্ট নং ইউ ৪৯৮৫৩৮৯। ওই বছরের ২৮ জুলাই কলকাতা থেকে ইস্যু করা পাসপোর্টে রবিউলের নাম আরাভ খান হিসাবে উল্লেখ করা হয়। রবিউল তার নামে একজনকে আত্মসমর্পণ করার জন্য ভাড়া করেছিলেন।

ভাড়া করা ওই ব্যক্তি আত্মসমর্পণের পর ৯ মাস কারাগারে ছিলেন। এই মামলায় ২০১৯ সালের ১১ এপ্রিল গোয়েন্দা পুলিশ রবিউলসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট জমা দিয়েছে। আরাভ এখন দুবাইয়ে আছেন। সেখানে গড়েছেন হাজার কোটি টাকার সম্পদ।