উন্নয়নের আড়ালে কি চলছে আসলে


Apurbo Ahmed Jewel
উন্নয়নের আড়ালে কি চলছে আসলে

বর্তমানের আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার গত ১০ বছর টানা ক্ষমতায় থেকেছে। আরও পাঁচ বছরের জন্য ক্ষমতায় এসেছে। এই সরকারের মূল স্লোগান হচ্ছে ‘উন্নয়ন’। তাই তারা ঢাকা শহর ও দেশজুড়ে অনেক অবকাঠামো বানিয়েছে। রাস্তার লেন বাড়ানো, উড়ালসেতু ও সড়ক, নদীর নিচ দিয়ে টানেল, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ও সমুদ্রবন্দর—এমন আরও প্রকল্প পরিকল্পনা তাদের আছে। তারা তো বলছে উন্নয়ন হচ্ছে। উন্নয়ন জোয়ারে ভাসছে দেশ। কিন্তু এই উন্নয়নের মিষ্টি ফল আমরা কতটা পাচ্ছি সেটাই হল চিন্তার বিষয়। এই ধরনের উন্নয়ন প্রকল্পগুলো কতটা হিসাবনিকাশ করে কিংবা আদৌ কোন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার মাধ্যমে কি হাতে নেওয়া হচ্ছে? নাকি ‘উন্নয়ন’ করতে হবে, তাই এসব প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে? শুধু অবকাঠামো বানানোই কি উন্নয়ন?

গত ১০ বছরে ঢাকায় দুটি উড়ালসড়ক হয়েছে। অনেক রাস্তা ঢাকা পড়ছে এই উড়ালসড়কের নিচে। কিন্তু ঢাকা শহরের মানুষের চলাচল কি সহজ হয়েছে? পরিসংখ্যান তা বলছে না। বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণা বলছে, ১১ বছর আগে ঢাকায় যানবাহনের গড় গতি ছিল ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার। এখন তা ৭ কিলোমিটারে নেমে এসেছে। মানুষ যে গতিতে হাঁটে তা সাধারণভাবে ৫ কিলোমিটার। সরকারের যতই উন্নয়নের হিসাব দিক  জনগণ এর ফল বা সুবিধা ভোগ না করতে পারলে সেই উন্নয়ন মূল্যহীন।

বিশ্বব্যাংকের গবেষণার কথা বাদ দিলেও সাধারণ মানুষের অভিজ্ঞতা পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে জনগণের ভোগান্তি খুব একটা কমেনি। এই যেমন- ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেন হয়েছে। চার লেন হওয়ার আগে কত ঘণ্টা লাগত ঢাকা-চট্টগ্রাম যাতায়াতে আর এখন কত ঘন্টা লাগে সেই হিসেব তো আমাদের চোখের সামনেই। অবস্থা আগের চেয়ে খারাপ হয়েছে। এটা কেন হয়েছে? সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে। এই সড়কে উল্টো পথে ট্রাক-বাস চলে, নিয়ম না মেনে যেখানে–সেখানে যানবাহন থামে, বিভিন্ন স্থানে মহাসড়কে বাজার বসে। এগুলো নিয়ন্ত্রণ না করে শুধু সড়ক বানালেই তো হবে না।

একটি দেশের পরিবহনব্যবস্থা বা শহর কীভাবে গড়ে ওঠে, এর ব্যবস্থাপনা কীভাবে হয়, নাগরিকদের সুবিধা কীভাবে নিশ্চিত করা হয়, কীভাবে পরিকল্পনা করা হয়, তার উদাহরণ বিশ্বের দেশে দেশে রয়েছে। এমনকি একসময়ে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছিল এমন নগর বা পরিবহনব্যবস্থাকে কীভাবে ঢেলে সাজানো যায়, বদলে ফেলা যায়, নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করা যায়, তার অনেক নজিরও রয়েছে।

ঢাকা শহরে দুইটি উড়ালসড়ক হয়েছে তার মানে উন্নয়ন হয়েছে বলা হচ্ছে সরকারের পক্ষ থেকে। কিন্ত বাস্তবে দেখা যায় উড়ালসড়কের নিচের রাস্তাগুলোর পরিত্যক্ত অবস্থা। একসময়ের চওড়া রাস্তাগুলো এখন সরু হয়ে গেছে। পরিণত হয়েছে ময়লা ফেলার ভাগাড়ে। অথবা পড়েছে দখলের কবলে। উড়ালসড়কের নিচের অবস্থা কতটা খারাপ হতে পারে, তা মগবাজার-মৌচাক উড়াল সেতুর নিচ দিয়ে চললে টের পাওয়া যায়। শুধু ময়লা–আবর্জনা নয়, সেখানে রাস্তার মাঝখানে বাজার বসে। এর মানে কি? এখানেও সঠিক পরিকল্পনা কিংবা ব্যবস্থাপণার অভাব।

শহরের মধ্যে এ ধরনের উড়ালসড়ক বানানো প্রমাণ করে আমাদের পরিকল্পনায় যেমন কোনো আধুনিকতা নেই, তেমনি নেই দূরদৃষ্টি। উন্নত বিশ্বে উড়ালসড়ক মূলত তৈরি হয় কোনো ব্যস্ত শহরে ঢোকার ও বের হওয়ার পথে। যাতে যানবাহন বাধাহীনভাবে শহর থেকে বের হতে বা ঢুকতে পারে। শহরের ভেতরে কোনো রাস্তায় উড়ালসড়ক তৈরির অর্থ সেই রাস্তাটি মেরে ফেলা। তাই এখন উন্নয়নের নামে যা হচ্ছে তা একেবারেই সমন্বয়হীণ।

উন্নয়ন মানে পরিকল্পনার ক্ষেত্রে উন্নয়ন, ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে উন্নয়ন। পরিকল্পনায় যেমন দূরদৃষ্টি থাকতে হয়, ভবিষ্যতের বিবেচনা থাকতে হয়, তেমনি কোন প্রকল্প প্রাধান্য পাবে বা কোনটি পাবে না, তার যৌক্তিক বিচার-বিবেচনাও থাকতে হয়। হাজার হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প পাস হচ্ছে। অথচ পরিকল্পনা পর্যায়ের সমস্যা রয়েই যাচ্ছে। উন্নয়ন নিয়ে আমরা আসলেই বড় ধরনের বিভ্রান্তিতে আছি। রাস্তা,সেতু বানানো আমাদের কাছে উন্নয়ন, কিন্তু এর জন্য যে পরিকল্পনার ক্ষেত্রেও ‘উন্নয়ন’ লাগবে, তার কোন খবর নেই।

পরিকল্পনাহীন উন্নয়ন উন্নয়ন নয়, অযৌক্তিক উন্নয়নও উন্নয়ন নয়। কী করতে হবে বা কেন করা হবে, তা পরিকল্পিত ও যৌক্তিক হতে হবে। উন্নয়ন মানে এমন কিছু করা, যাতে জনগণ উপকৃত হয়। শুধু অবকাঠামো তৈরি মানেই উন্নয়ন নয়। অবকাঠামোগত উন্নয়নের ক্ষেত্রে বহুমাত্রিকতার দিকে নজর থাকতে হয়। বিবেচনায় রাখতে হয় একটি অবকাঠামো যেন অন্যটির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। আর ঠিকমতো ব্যবস্থাপনা করতে না পারলে অবকাঠামো বোঝায় পরিণত হয়। তাই ব্যবস্থাপনার উন্নয়নও সমানভাবে জরুরি। উন্নয়নকে সামগ্রিকভাবে না দেখে অবকাঠামো বানানোতে আটকে ফেললে জনগণ তার ফল ভোগ করতে পারবে না