সংসারের হাল ধরা ছেলের মৃত্যু, শোকে পাথর মা-বাবা


দৈনিক আলোড়ন
সংসারের হাল ধরা ছেলের মৃত্যু, শোকে পাথর মা-বাবা

করিমগঞ্জের মোবারক হোসেন হৃদয় (২০) চাকরি করতেন সিদ্দিক বাজারের একটি স্যানিটারি দোকানে। বেতন পেতেন মাসে ১০ হাজার টাকা। বাবা-মাসহ ঢাকায় একসঙ্গেই থাকতেন। অসুস্থ বাবা আবুল হাশেম (৪৫) গুলিস্তানে খোলা আকাশের নিচে পান বিক্রি করতেন। তিনিও পরিবারে সামান্য সহায়তা করতেন। এভাবেই চলে যাচ্ছিল হৃদয়দের সংসার।

কিন্তু মঙ্গলবারের ভয়াবহ বিস্ফোরণ কেড়ে নিল হৃদয়ের প্রাণ। এখন পরিবারটির পথে বসার উপক্রম। বাবা এতটাই শোকার্ত হয়ে পড়েছেন, তাকে বাড়িতে স্যালাইন দিয়ে রাখা হয়েছে। মা আনোয়ারা বেগমের কান্নাও থামাতে পারছে না কেউ। হৃদয়কে বাড়ির আঙিনায় দাফন করা হয়েছে। গতকাল বুধবার করিমগঞ্জের নোয়াবাদ ইউনিয়নের উলুখলা গ্রামে হৃদয়দের বাড়িতে গিয়ে এমন দৃশ্য দেখা যায়।

হৃদয়ের ছোট ভাই জয় এবং তার চাচাত ভাই আল আমিন ও চাচাত দুলাভাই বাবুল দেওয়ানের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হৃদয়সহ তারা তিন ভাই এক বোন ছিল। হৃদয় সবার বড়। তার ছোট দুই জমজ ভাই জয় আর তয়। বোন তায়েবা সবার ছোট। জয় প্রাইমারি পড়াশোনা শেষ করে প্রায় ৮ বছর আগে ঢাকায় গিয়ে চাকরি নেয়। সর্বশেষ সিদ্দিক বাজারে ‘আসমা স্যানিটারী’ নামে ঢাকার মালিকের একটি দোকানে চাকরি করতো। হৃদয় তার পরিবার নিয়ে সিদ্দিক বাজারের পাশেই জাভেদের গলিতে সাত হাজার টাকার বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতেন। বাবা শারীরিকভাবে এতটাই দুর্বল, তিনি কোনো পরিশ্রমের কাজ করতে পারেন না। তাকে গুলিস্তানে খোলা আকাশের নিচে একটি পান দোকানের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন হৃদয়। মঙ্গলবার বিকেলে বিস্ফোরণের আগে বাবা হৃদয়কে খবর পাঠিয়েছিলেন পান বিক্রির জন্য কিছু ছোট পলিব্যাগ দিয়ে আসার জন্য। হৃদয় দোকান থেকে বের হতেই পাশের সাততলা ভবনে ভয়াবহ বিস্ফোরণ। বাবা বুঝতে পারেননি ছেলের মর্মান্তিক পরিণতির কথা। দীর্ঘক্ষণ পরও যখন হৃদয় বাবার কাছে যাচ্ছেন না, তখনই শুরু হয় খোঁজাখুজি। কোন সন্ধান না পেয়ে রাত ৮টার দিকে বাবা আবুল হাশেম, হৃদয়ের চাচা মমিন মিয়া ও মামা আবু হানিফ ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে গিয়ে হৃদয়ের নিথর দেহ শনাক্ত করেন। তার মাথাসহ সারা শরীরে ভয়ঙ্কর সব ক্ষতচিহ্ন। দৃশ্য দেখেই বাবা চিৎকার দিয়ে ওঠেনে। তখন থেকেই তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। এখন বাড়িতে তাকে স্যালাইন দিতে হচ্ছে।

গতকাল বুধবার সকাল সাতটার দিকে একটি অ্যাম্বুলেন্স দিয়ে হৃদয়ের বন্ধুরা মরদেহটি তার গ্রামের বাড়িতে নিয়ে আসেন। সকাল ১০টায় বাড়ির পাশে উলুখলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে জানাজা পড়িয়ে সাড়ে ১০টায় বাড়ির আঙিনায় দাফন করা হয়েছে।

ছোটভাই জয় জানায়, সে নাজিরাবাজার এলাকায় বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান উচ্চ বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ছে। তার জমজ ভাই তয় নারায়ণগঞ্জে একটি মাদ্রাসায় পড়ছে। এরই মধ্যে তয় পবিত্র কোরআনের হাফেজ হয়েছে। ছোটবোন তায়েবা ঢাকায় একটি মাদ্রাসায় পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ছে। নিহত হৃদয় আর তার বাবার সামান্য আয় দিয়েই সব খরচ মেটানো হতো। জয় জানে না, এখন তার পড়াশোনার কী হবে। এখন তাদের পড়াশোনা দূরে থাক, খেয়েপরে বেঁচে থাকাটাই কঠিন হয়ে পড়বে বলে কাঁদতে কাঁদতে জানালেন হৃদয়ের চাচাতো ভাই আল আমিন।

হৃদয়ের মা আনোয়ারা বেগমের কান্না থামছে না। তাঁকে কেউ শান্ত করতে পারছেন না। বাবাকে তো স্যালাইন দিয়ে শুইয়ে রাখা হয়েছে।

হৃদয়ের চাচাতো দুলাভাই বাবুল দেওয়ান বললেন, হৃদয় এই বয়সেই খুব দায়িত্বশীল ছিল। বলতে গেলে একাই পরিবারটির হাল ধরেছিল। তার মৃত্যুতে এলাকার সবাই শোকাহত।

সরকারের কাছে পরিবারটির জন্য আর্থিক সহায়তা দাবি করেন বাবুল দেওয়ান।